সর্বধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী মিছিল কলকাতায়
উৎসবের আনন্দ যে ধামাচাপা দেয়নি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনকে, তা বুঝিয়ে দিল কলকাতা। বৃহস্পতির মেঘলা বিকেলে একটি ধর্মীয় সংগঠনের ডাকে সর্বধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী মিছিলে পা মেলালেন মহানগরবাসী।
সিএএ-বিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে গান্ধীমূর্তির দিকে হন হন করে হেঁটে চলেছিলেন শিরিন হাইরাপিয়েট। হিউস্টন কমিউনিটি কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক শিরিন দেশে ফিরেছিলেন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে। কিন্তু, নাগরিকত্ব আইন তাঁকে ঘরে বসতে দেয়নি। শিরিন বলছিলেন, ‘অনেকে বলছেন, এটা একটা ধর্মের ব্যাপার। কিন্তু আমি মনে করি, এটা আমার দেশের ব্যাপার। আমার দেশের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এই অবস্থায় উৎসব উদ্যাপনের থেকে পথে নেমে প্রতিবাদ করা বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেছি।’ পাশেই হাঁটছিলেন মধ্যবয়স্ক ব্যবসায়ী জুলফিকার আহমেদ। খানিক বিদ্রুপের সুরে বললেন, ‘আমি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। ওরা সংবিধান-বিরোধী এমন একটা আইন করেছে বলেই আমরা সবাই ধর্মের পরিচয় ভুলে এক হয়েছি।’
বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটেয় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মিছিলের ডাক দিয়েছিল আর্চ-ডায়োসেস অফ কলকাতার লেইটি কমিশন এবং সোশ্যাল কমিউনিকেশনস কমিশন। যে আন্দোলনের মূল কারণই ‘ধর্ম’, সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তরফে কেন পথে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা? আর্চ-ডায়োসেস অফ কলকাতার লেইটি কমিশনের সম্পাদক অ্যালেকজান্ডার অ্যান্টনি বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছিল, নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করা উচিত। এবং এই নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে আমরা, সেটা জানানো প্রয়োজন। তাই আর্চবিশপের কাছে একটি মিছিল করার অনুমতি চাই আমরা। উনি ধর্মনিরপেক্ষ এবং অরাজনৈতিক মিছিল করার নির্দেশ দেন। সেই মতোই এই মিছিলের আয়োজন।’
আক্ষরিক অর্থেই বৃহস্পতিবারের এই মিছিল ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। অন্তত ১০টি চার্চের প্রধান পুরোহিত (প্রিস্ট) এবং বেশ কিছু চার্চের সিস্টাররা মিছিলে যোগ দেন, কিন্তু নিজেদের ধর্মীয় পোশাকে নয়। মিছিলে পা মেলান রাজ্যের একমাত্র অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বিধায়ক মাইকেল ক্যালভার্ট। ছিলেন প্রভিনশন অফ লরেটো সিস্টারস সাব্রিনা এডওয়ার্ডসও। পথে নেমে প্রতিবাদের পথ বাছলেন কেন? ‘একজন মহিলা এবং নারীবাদী হিসেবে আমরা অন্তর্ভুক্তির কথা বলি, বিভেদের কথা নয়। আর এখন মানুষে মানুষে বিভেদের কথা চলছে। যার প্রতিবাদ করা উচিত। তাই মিছিলে পা মিলিয়েছি,’ জানান সাব্রিনা।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, চার্চের ঘোষণার মাধ্যমে খবর পেয়ে মিছিলে পা মেলাতে এসেছিলেন কনটেন্ট রাইটার অগ্নিভ, হাইকোর্টের আইনজীবী সৈয়দ এহতেশাম হাদা, মেক আপ আর্টিস্ট জৈনাম আসরফ, লেখিকা করুনা এজারা পারেখ, বেসরকারি সংস্থার কর্মী অবনীশ নারাং, শিল্পী সুমনা চক্রবর্তীর মতো অনেক তরুণ তুর্কিই। ঐক্য দেখাতে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ মহিলাও। তরুণ প্রজন্ম উৎসব উদ্যাপন ফেলে কেন ছুটে আসছে মিছিলে? প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসেন করুণা। বলেন, ‘এই নিয়ে পঞ্চম বা ষষ্ঠ মিছিলে হাঁটছি আমি। আসলে যে ভারত আমাদের উপহার দেওয়া হচ্ছে, সেই ভারত আমার ভারত নয়। আমাদের কাছে ভারতের মানেটা আলাদা। সেটা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। আমি তো বটেই, আমার মনে হয় যাঁরা এই প্রতিবাদের জন্য পথে নামছেন, তাঁরা সবাই সেই বিশ্বাস থেকেই পথে নামছেন।’ কিন্তু, পথে নেমে প্রতিবাদ করে কি লাভ হবে? সৈয়দ এহতেশাম হাদা বলে ওঠেন, ‘ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপর সম্পূ্র্ণ ভরসা আছে আমার। এই আইন তুলে নেওয়া হবেই।’