মকবুল ফিদা হুসেন – ধর্মান্ধতার শিকার এক চিত্রশিল্পী
লন্ডনের রয়াল ব্রম্পটন হাসপাতালে প্রায় এক দশক আগে মারা যান ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন৷ স্বেচ্ছানির্বাসনেই তাঁর জীবনাবসান হয়৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ভাষায়: ‘‘তাঁর মৃত্যু এক জাতীয় ক্ষতি৷” ভারতের চিত্রশিল্পের পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন হুসেন৷ তাঁর মৃত্যু শিল্পের জন্য যে এক বড় রকমের ক্ষতি, তা বোঝা যায় সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে প্রকাশিত দৈনিক নয় স্যুরশার সাইটুং পড়লেই। হুসেন সম্পর্কে তারা লিখছে:
‘‘শিল্পী মহলে হুসেন প্রায়শই ভারতের পিকাসো বলে অভিহিত হয়েছেন৷ অত্যন্ত খামখেয়ালি এক জিনিয়াস হিসেবে প্রসিদ্ধি ছিল তাঁর৷ অভিজাত ক্যালকাটা ক্লাব একবার তাঁকে ঢুকতে দেয়নি ক্লাবের পোশাকবিধি না মান্য করায়৷ বার্তামাধ্যমে এই ঘটনার কঠোর সমালোচনা করা হয়৷
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সমাজ আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় রকমের যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, তার ছায়া পড়েছে হুসেন’এর জীবনে৷ নব্বই’এর দশকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের উজ্জীবনের সময় বহু হিন্দু সংগঠনের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ঘৃণার পাত্র৷”
উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হাতে মকবুল ফিদা হুসেন নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ তাঁর আঁকা দেবী সরস্বতীর নগ্ন প্রতিকৃতি নিয়ে এই সব সংগঠন হয়ে ওঠে মারমুখো৷ সেকথা জানিয়ে নয় স্যুরশার সাইটুং লিখছে:
‘‘১৯৯৮ সালে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুম্বই’এ শিল্পীর বাড়িতে চড়াও হয়৷ তাঁর আঁকা বেশ কিছু ছবি নষ্ট করে দেয়৷ একই সময়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয় তাঁকে৷ ২০০৬ সালে দেশ ছাড়েন তিনি৷ দুবাই অথবা লন্ডন হয় তাঁর বাসস্থল৷ ২০১০ সালে কাতারের আমীর নাগরিকত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেন শিল্পীকে৷ তিনি তা গ্রহণ করেন৷”
আনন্দবাজার পত্রিকার কলমে: “শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন-এর একটিই প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘শো-ম্যান’ মকবুল ফিদা হুসেন। একে অন্যের পরিপূরকও বটে। সাদা পোশাক, বিদেশি গাড়ি, দীর্ঘ তুলি, নগ্নপদ এবং তপ্ত বিতর্ক-সহকারে তিনি ভারতীয় শিল্পের বিচিত্র প্যাকেজিং। জীবদ্দশায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”
উনিশশো পঞ্চাশ-একান্নতে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা ছবি দেড়শো টাকায় বিক্রি হয়নি, কিন্তু শতক শেষের আগেই তাঁর ছবি হয়ে ওঠে সংগ্রাহকের সম্পদ। এক-একটি ছবির দাম কোটির ঘরে পৌঁছয়। ছবি আঁকার সরঞ্জাম কেনার জন্য তিনি এঁকেছেন সিনেমার বিশাল হোর্ডিং, রং করেছেন কাঠের খেলনা, দোকানের জন্য নতুন নতুন নকশার আসবাব এঁকেছেন। দীর্ঘকাল তাঁর স্টুডিয়ো ছিল গ্র্যান্ট রোডের ফুটপাথ।
সমকালীন ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে তিনি বিশিষ্টতম, অথচ সেই পরিচয়কে ছাপিয়ে গেল তাঁর বিতর্কিত ভাবমূর্তি।