করোনা মোকাবিলাতেও বিজেপির স্বজনপোষণ
করোনা ঠেকাতে লাগু হওয়া লকডাউনে ত্রাণ কাজে যেসকল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় আছে তার মধ্যে অন্তত ৭৩৬তি আরএসএস অনুমোদিত। এই পরিসংখ্যান ১৩ই মে পর্যন্ত। এই সকল সংস্থা রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতী নামক এক নথিভুক্ত ট্রাস্টের অধীন। ২০০৫ সালের ডিসঅ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে এই সকল সংস্থা স্টেট ডিস্যাস্টার রিলিফ ফান্ডের অনুদান পাচ্ছে ত্রানের জন্য ভর্তুকিযুক্ত মুল্যে খাদ্যশস্য কিনতে।
লকডাউনের প্রথম থেকেই ত্রাণ বন্টনে আরএসএসের আধিপত্য নজরে পড়েছে। তিনবার নিষিদ্ধ হওয়া সংস্থা এই সঙ্ঘ ত্রাণ বণ্টনকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রচার করছে। রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর এই আর্থিক সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য কারণ আরএসএস কখনো এই ত্রানে সরকারি অনুদান পাওয়ার কথা বলেনি।
২০১৪ সালের রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর রুস্টার অনুযায়ী তাদের ৫৭ হাজার আর্থিক ও সামাজিক প্রকল্প আছে যা অন্তত ৯২৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দ্বারা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দেখা যাবে এনজিও দর্পণ নামক সাইটে যা নীতি আয়োগ দ্বারা পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর দাবী এই সংস্থাগুলি স্বাধীন শুধুমাত্র একই চিন্তাধারার জন্য আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত। অথচ ২০১৪ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর পাঁচ বছরের রিপোর্টে একটি ভাগ লেখেন ভাইয়াজী জোশী, যিনি আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান, তিনি লেখেন, “এই শাখাগুলি স্বাধীন কিন্তু আরএসএসের সাহায্যপ্রাপ্ত। এই সংস্থার সঙ্গে যুক্তরা স্থানীয় আরএসএসের ধাঁচে কাজ করেন এবং তারা আরএসএসের পতাকা নিয়ে কাজ করেন না কিন্তু, স্বয়ংসেবকদের নির্দেশেই কাজ করেন।” আরও দেখার বিষয় রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর যারা উচ্চপদে আছেন, তারা আরএসএসেরও উচ্চপদে আছেন।
অসমের বৌধিক প্রমুখ শঙ্কর দাস বলেন সঙ্ঘের ৪৬টি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। সঙ্ঘের অধীন কটি সংস্থা আছে, ঠিক করে সেটা বলা সম্ভব না কারণ, সঙ্ঘ নথিভুক্ত সংস্থা না এবং তারা কর দেয় না। সমস্ত সংস্থাকে একসঙ্গে বলা হয় সঙ্ঘ পরিবার। কিন্তু, আরএসএসের সমস্ত লেখা পড়ে মানুষের মনে ধারনা হবে এটি আত্মনির্ভর সংস্থা। এও ধারনা হবে স্বয়ংসেবকদের থেকে প্রাপ্ত গুরুদক্ষিণাই একমাত্র তাদের আয়ের উৎস। আরএসএসের স্বয়ংসেবকদের বক্তব্য তাদের আয়ের উৎস নিজেরাই এবং কখনো কখনো সমাজ থেকে অনুদান পায়।
রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর ওয়েবসাইটও বেসরকারি সংস্থাকে বলে তাদের সিএসআর ফান্ড তাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে দিতে। দ্বিতীয় দফার লকডাউনে নীতি আয়োগ বেসরকারি সংস্থাদের আর্জি জানান তাদের তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের সিএসআর দিতে। বর্তমানের আইন অনুসারে বেসরকারি সংস্থা তাদের লাভের দুই শতাংশ সিএসআরে ব্যয় করতে বাধ্য।
২৫মার্চ শুরু হওয়া লকডাউনের চতুর্থ দিনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নথিভুক্ত করা ও ত্রানের জন্য তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য করা। অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণায় আমরা করুন অবস্থা দেখেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের। ২৯ মার্চ ১১টি এমপাওয়ারড কমিটি তৈরী করা হয় এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে। এর মধ্যে একটি কমিটি যার নাম ইজি৬, তার মাথায় ছিলেন অমিতাভ কান্ত, নীতি আয়োগের এক্সিকিউটিভ অফিসার। এই কমিটির কাজ ছিল বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা।
এই কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ৫ই এপ্রিল। এরপর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় নীতি আয়োগের সিইও নথিভুক্ত ৯২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে লিখেছে সরকারকে সাহায্য করতে। পাঁচদিন পর প্রধানমন্ত্রী সকল এমপাওয়ারড কমিটির সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রীর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পরামর্শ দিয়েছেন সরকারি জিনিসপত্রের সঠিক ব্যবহার করতে জেলাস্তরে সকল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে।
এরপরদিন অর্থাৎ ১১ই এপ্রিল ফুড কর্পরেশন অফ ইন্ডিয়া সার্কুলার জারি করে জানায় তারা এই সংস্থাদের খাদ্যশস্য দেবে কোনও নিলাম ছাড়া।
২৫এপ্রিল একদল মন্ত্রীকে নিয়ে একটি এগজিকিউতিভ বডি গঠন করেন মোদী এবং পর্যালোচনা বৈঠক করেন। ৩রা ফেব্রুআরি কেন্দ্র স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বডি গঠন করেন। কান্ত এই বডিকে বলেন, এই সংস্থাদের রাজ্য তাদের এসডিআরএফ তহবিল দিয়ে এবং ফুড কর্পরেশন অফ ইন্ডিয়া ভর্তুকিযুক্ত মুল্যে খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করছে।
পরদিন উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেন আরএসএস এই ত্রাণ সামগ্রী নিজেদের সামগ্রীর মত বিলি করছে। আরএসএস এই ত্রাণ শুধু বিজেপি সমর্থক পরিবারকেই দিচ্ছে। কাশীর আরএসএসের এক প্রচারক তথা প্রাজ্ঞ প্রভাসের সদস্য রমাশিস সিং এই অভিযোগ খারিজ করে উপরন্তু বলে অখিলেশের কি কি যোগ্যতা আছে?
৪ঠা মে ইজি৬ এর আরেকটি বৈঠক করেন কান্ত যেখানে সমস্ত পরিকল্পনা যা বাস্তবায়িত করেছে ঐ কমিটি, আলোচনা হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই কমিটি সমন্বয়ের পাশাপাশি নজর রাখছে সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে এবং ৭০০ জেলাশাসকের সঙ্গে করোনা ঠেকাতে। ৯২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভালো কাজ করছে। এর পাশাপাশি সমস্ত চিফ সেক্রেটারিকে নির্দেশ দেওয়া হয় রাজ্যস্তরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় রাখতে নোডাল অফিসার নিযুক্ত করার।
এই মুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও এসডিআরএফের মধ্যে কত টাকার লেনদেন হয়েছে, তা জানার উপায় নেই। এও জানা যায়নি ঠিক কত টাকা দরে খাদ্যশস্য পেয়েছে তারা।
রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর সাধারন সম্পাদক শ্রাবন কুমারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন তিনি এসডিআরএফের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। আমাদের সকল ইউনিট স্বাধীনভাবে কাজ করে। তিনি বলেন তারা ফুড কর্পরেশনের সার্কুলারের কথা জানেন এবং নির্দেশ দিয়েছিলেন এই প্রকল্পকে কাজে লাগাতে। তিনি বলেন আরএসবিকে তিনি নিজে নথিভুক্ত করেন নি। সমস্ত রাজ্য নিজের মত করে কাজ করে। অন্য কেউ নথিভুক্ত করে থাকতে পারে। আমরা নথিভুক্ত ট্রাস্ট এবং আইন মানি। তাই, আমরা জনগন এবং বেসরকারি সংস্থার থেকে টাকা তুলতে পারি। বেসরকারি সংস্থার সিএসআর তহবিল সঠিক ভাবে ব্যবহারে লাগাতে রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতী একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।
কেরলের রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতীর প্রধান ডি বিজয়ন অবশ্য জানান তারা ফুড কর্পরেশনের পাশাপাশি এসডিআরএফের সুবিধাও নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এসডিআরএফের তহবিল পেতে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিয়েছি ও তহবিলের অপেক্ষা করছি।
আরএসএস ৯৫ বছরের ইতিহাসে কখনো নিজেকে নথিভুক্ত করেনি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোহন ভাগবত বলেন কেন তারা কর দেয়না না নথিভুক্ত করায় না। তিন বলেন, ১৯২৫ সালে ভারত পরাধীন ছিল এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এমন কোনও আইন নেই যে কোনও সংস্থাকে নথিভুক্ত করতেই হবে এবং আইন অনুযায়ী সঙ্ঘ হল একটি গোষ্ঠী, তাই, আমরা কর দিই না।
শুধু নীতি না অনেক কিছু থেকেই বোঝা যায় আরএসএস ও আরএসবি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আরএসবির উপ প্রধান ঋষিপাল দাদওয়াল রাষ্ট্রীয় সংগঠন মন্ত্রী। ২০১৯ সালের ফেব্রুআরিতে যখন সমাজবাদী দলের নেতা অমর সিংহ তা সম্পত্তির একাংশ আরএসবিকে দান করে, দাদওয়াল সেই রেজিস্ট্রির সময় উপস্থিত ছিল। আরএসবির বর্তমানের সম্পর্ক অধিকারী ২০১৮ পর্যন্ত প্রান্ত প্রচারক ছিল। আরএসএসের রাজ্যের সীমানা ঠিক দেশের মানচিত্রের মত না। তাদের এক প্রকাশনায় জানা যায় আরএসএসের মতে ভারতে রাজ্য ৪১টি এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সাতটি।