নবাবদের শহর মুর্শিদাবাদ – ইতিহাসের হাতছানি
ভাগীরথী নদীর তীরে বাংলার শেষ রাজধানী মুর্শিদাবাদ। শহরটি এখনও নবাবদের একাধিক স্মৃতি বহন করে চলেছে। হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া একাধিক ছোটবড় মসজিদ ছাড়াও পুরো মুর্শিদাবাদ জুড়ে দেখার জায়গার অভাব নেই।
ব্রিটিশ শাসকরা কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তরিত করার আগে এই শহরের যে কি গরিমা ছিল তা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। নবাবরা মসজিদ, সমাধি এবং উদ্যান নির্মাণ করে শহরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। মুর্শিদাবাদ ঘুরতে এলে আগে অবশ্যই এই জায়গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে একটু পড়ে আসা প্রয়োজন নাহলে ভ্রমণ করবেন ঠিকই আর তা করে সামান্য একটু আনন্দ পাবেন এই-যা। ইতিহাসের রোমাঞ্চ ফিল করতে পারবেন না।
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ:
১০০০টি দরজা থাকার জন্য এই প্রাসাদের নাম হয় হাজারদুয়ারি। প্রাসাদের ৯০০টি দরজা আসল। অনেকেরই ভুল ধারণা যে এই প্রাসাদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নির্মাণ করান। তা কিন্তু একেবারেই নয় এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮২৯ সালে, এবং নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ১৮৩৭ সালে, সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর ৮০ বছর পরে।
সিরাজউদ্দৌলার সাথে এই প্রাসাদের সরাসরি কোনো সম্পর্কই নেই। নবাব সিরাজউদৌল্লার এক সময়ের আজ্ঞাবহ মীরজাফরের বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের নির্দেশে ১১৪টি ঘর ও ৮টি গ্যালারি সম্বলিত এই প্রাসাদটি তৈরি করেন ডানকান ম্যাকলিওড। হাজারদুয়ারি প্যালেসের ভিতর তৈরি করা মিউজিয়ামে বাংলার প্রাচীন নবাবদের একাধিক নিদর্শন রয়েছে। চিন থেকে আমদানি করা হাতির দাঁত দিয়ে এই প্রাসাদের কারুকার্য তৈরি করা হয়েছে।
বড়া ইমামবরা:
হাজারদুয়ারি প্যালেসের উল্টো দিকে ১৮৪৭ সালে নির্মিত নিজামাত ইমামবাড়া বাংলা তথা ভারতের অন্যতম বৃহৎ। নবাব নাজিম মনসুর আলি খান ফেরাদুন জাহ কতৃক নির্মিত এই ইমামবাড়ার আশাপাশের বাছছাওয়ালি তোপ, দক্ষিণ দরওজা, ছক দরওয়াজা, ঘড়ি ঘর এই স্থানের অন্যতম আকর্ষণ। ইমামবাড়ার দৈর্ঘ্য ৬৮০ ফুট।
মহরমের সময় এখানে প্রচুর জনসমাগম এবং পরব পালন হয়। মহরমের সময়ে এই স্থান সকল ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বছরের অন্যান্য সময়ে এই ইমামবড়া বন্ধ থাকে, ফলে আপনি শুধু বাইরে থেকেই দেখতে পারেন।
মদিনা মসজিদ:
নিজামাত ইমামবারার ঠিক সামনে ক্ষুদ্রকায় এই মসজিদ মায়ের ইচ্ছায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা কারবালা থেকে মাটি এনে তৈরি করেছিলেন বলে কথিত আছে। সাদা এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট।
খোশবাগ:
হাজারদুয়ারির নিকটেই ভাগীরথী নদীতে বোটে চড়ে আপনি খোশবাগে যেতে পারেন। খোশবাগে আলিবর্দি খান, সিরাজ, সিরাজপত্নী লুৎফউন্নিসা, এবং সিরাজের পরিবার পরিজনের কবর রয়েছে।
কাটরা মসজিদ:
নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭২৩ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই মসজিদের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে, তবে সরকার এই স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এই মসজিদের ৫টি গম্বুজ ছিল, কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দুইটি গম্বুজ ভেঙ্গে পড়ে। এই মসজিদে একসময়ে একসাথে ২,০০০ ব্যাক্তি প্রার্থনা করতে পারেন। কাটরা মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আগে একটি তোপখানা ছিল।
মোতিঝিল:
এই ঝিল এবং তৎসনলগ্ন বাগান সিরাজের পিসি ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজেশ মহম্মদ নির্মাণ করান। এই স্থান ‘কোম্পানি বাগ’ নামেও পরিচিত। এই ঝিলটি দেখতে ঘোড়ান নালের মত। এর তৎসংলগ্ন স্থানে রবার্ট ক্লাইভ সুবে বাংলার দেওয়ানিপ্রাপ্তি উদযাপন করেন । যদিও সেই উদযাপনস্থান এখন ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই মোতিঝিলের প্রাসাদে ওয়ারেন হেস্টিংস কিছুদিন বসবাস করেন। সরকার এখন মোতিঝিলের কাছেই একটি উদ্যান তৈরি করেছেন, এই স্থানের আলোকশোভা আপনি সন্ধ্যাবেলা দেখতে পারেন।
কীভাবে পৌঁছবেন
সড়ক ও রেলপথে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব যথাক্রমে ২৩০ ও ১৯৩ কিলোমিটার। সরকারি বাতানকুল কিম্বা বেসরকারি বাসে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে জেলার সদর শহর বহরমপুর পৌঁছতে সময় লাগার কথা সাড়ে পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা। অন্যদিকে ট্রেনে কলকাতা থেকে বহরমপুর পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে তিন থেকে পৌনে চার ঘণ্টা।
মুর্শিদাবাদ ঘুরতে হলে বহরমপুরকে বেস পয়েন্ট বানাতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় মিশ্র সংস্কৃতির এই শহর থেকে সিরাজ-ক্লাইভের স্মৃতি বিজড়িত দালানে পৌঁছতে গাড়ি বুক করতে হবে আপনাকে।
কোথায় থাকবেন
বহরমপুর কিম্বা লালবাগে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে পর্যটকদের থাকার জন্য। সিজনে না গেলে হোটেলে পৌঁছেও ঘর পেয়ে যাবেন। এছাড়া বহরমপুর রেলস্টেশনের কাছেই পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে। হাজারদুয়ারির কাছে রয়েছে সরকারি ইয়ুথ হস্টেলও। পিডব্লিউডি রেস্ট হাউস আর পৌর অতিথি নিবাসেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।