বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

ছাত্রের লেখা চুরি করেছিলেন সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ!

September 5, 2020 | 3 min read

সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে সারা দেশে পালিত  হয়। নিজের জন্মদিনকে এভাবেই নিজের জীবদ্দশাতেই; অমর করে দিয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। কিন্তু জানেন কি যে দুই খণ্ডের ‘ইন্ডিয়ান ফিলজফি’ বইটির জন্য; রাধাকৃষ্ণণ প্রসিদ্ধ, অভিযোগ সেটি মোটেই তাঁর লেখা নয়। সেটি নাকি লিখেছিলেন; তাঁরই ছাত্র যদুনাথ  সিংহ।  

১৯২৯ এর জানুয়ারি। মিরাট কলেজের দর্শনের তরুণ অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ, সারা ভারতের শিক্ষা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়ে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তুলে মামলা করে বসলেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য জমা দেওয়া যদুনাথের গবেষণা; “ইন্ডিয়ান সাইকলজি অব পারসেপশন” প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড  থেকে,  ব্যপকভাবে নকল করে ধরা পড়েছিলেন রাধাকৃষ্ণাণ।   

যদুনাথ সিংহ ১৯১৭ সালে এমএ পাশ করার পর; তাঁর গবেষণাপত্রের প্রথম খণ্ড ১৯২২ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমচন্দ রায়চন্দ স্কলারশিপের আবেদনের সঙ্গে জমা দিয়েছিলেন। অভিযোগ, এই গবেষণাপত্রের দ্বিতীয় খণ্ড থেকেই অনেকটা নকল করে; রাধাকৃষ্ণ ১৯২৭ সালে একটি বই লন্ডন থেকে স্বনামে প্রকাশ করেন। ওই সময়ে রাধাকৃষ্ণাণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চপদে  কর্মরত ছিলেন।

যদুনাথ তাঁর অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্যের জন্য ১৯২৩ সালে গ্রিফিথ পুরস্কার; ১৯২৪ সালে মোয়াট মেডেল ও তার আগে ১৯১৫-১৬ সালে ক্লিন্ট মেমোরিয়াল ও ফিলিপ স্মিথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণাণ বইটি লন্ডন থেকে প্রকাশ করার বেশ কিছু দিন পর; তা যদুনাথের নজরে আসে। তাঁর মতে, ‘ইন্ডিয়ান ফিলজফি’ বইটির অনেকটা অংশ; তাঁর গবেষণাপত্রের হুবহু নকল। তিনি ১৯২৯ সালের ২২ অগস্ট কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন।  

১৯২৫ সালে যদুনাথের গবেষণা শেষ হয়েছিল। আর ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণানের বই; “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”র দ্বিতীয় খণ্ড।  যদুনাথ সুদূর মিরাটে থাকার দরুন কলকাতার শিক্ষা সমাজের সব খবর যথাযথ সময়ে ঠিকঠিক পেয়ে ওঠেন নি। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পান নি যে; তাঁর মৌলিক গবেষণাটি থেকে রাধাকৃষ্ণাণ েভাবে টুকলি করে বসে ছিলেন।

বিষয়টি তাঁর গোচরে য়াসতেই পরের বছর; অর্থাৎ ১৯২৮ সালে রাধাকৃষ্ণাণের “দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ” নামে;  আরও একটি বই বেরোল। এই বইটি ছিল আসলে “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”-র দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের একটি পুনর্মুদ্রণ।  এই বইটি পড়েই যদুনাথ আবিষ্কার করেছিলেন যে, তাঁর গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ; নিজের বইতে টুকে বসিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান!     

ক্ষুব্ধ যদুনাথ, সরাসরি রাধাকৃষ্ণাণকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে, দীর্ঘ এক চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত “মর্ডার্ন রিভিয়্যু” ইংরেজি পত্রিকার দপ্তরে। কারণ রাধাকৃষ্ণাণের “ইন্ডিয়ান ফিলজফি”-র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর, এই পত্রিকাই দেখিয়েছিল যে রাধাকৃষ্ণান তাঁর বেশ কিছু  সিদ্ধান্তের পিছনে যথাযথ তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি। তারা সেই নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিল। কিন্তু রাধাকৃষ্ণাণ কোনো জবাব দেন নি।

প্রমাণ হাতেই ছিল। যদুনাথের গবেষণাকর্মের প্রথম দুই অধ্যায়ের নির্যাস নিয়ে, যদুনাথ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রাধাকৃষ্ণাণের বই প্রকাশিত  হওয়ার আগেই, ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে মিরাট কলেজের পত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলেছিলেন।

এই খবরটা সম্ভবত রাধাকৃষ্ণাণ জানতেন না। কিন্তু এর ফলে যদুনাথের পক্ষে রাধাকৃষ্ণাণের চুরি প্রমাণ করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। মর্ডার্ন রিভিয়্যুর পাতায় নিজের লেখা থেকে এবং রাধাকৃষ্ণানের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করে করে, চুরির বহর সে সময় সবিস্তারে দেখিয়েছিলেন যদুনাথ।

১৯২৯ এর আগস্টে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে; যদুনাথ স্বত্বাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবী করেন কুড়ি হাজার টাকা।

যদুনাথ সিংহ সুবিচার পাননি। শিক্ষাজগতের প্রবীণ সদস্যেরা প্রায় সকলেই যদুনাথের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। অনেকেই সহানুভূতিশীলও ছিলেন প্রকৃত বিদ্বান এই মানুষটির প্রতি। কিন্তু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক মহলে  তাঁর প্রতাপের কারণে, এঁরা কেউ সেদিন রাজি হননি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে। বরং রাধাকৃষ্ণাণের পরোক্ষ প্রভাবের কারণে যদুনাথ সিংহের উপর  তখন নানাভাবে চাপ তৈরি করা হয়েছিল আদালতকক্ষের বাইরে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য। এমনকি যদুনাথের গবেষণাপত্রের অন্যতম পরীক্ষক ব্রজেন শীল মশাইও, “বিশেষ অনুরোধ” করেছিলেন যাতে তাঁকে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে না ডাকা হয়।  

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও ছিল সেই সময় আশ্চর্যজনক। তাঁদেরই এক অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁদেরই এক গবেষকের মামলা চলছে, তাঁদেরই শিলমোহর পাওয়া গবেষণা নিয়ে। অথচ তাঁরা উচ্চবাচ্যও করেনি।

১৯২৯ এর আগস্টে শুরু হয়ে মামলা চলেছিল ১৯৩৩ এর মে মাস পর্যন্ত। মামলার বিপুল খরচ টানা, তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে উঠছিল। মামলার রফা-নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে। ১৯৩৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অ্যাক্টিং চিফ জাস্টিস ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সামনে; একটি ডিক্রির মধ্যে দিয়ে দুটি মামলা মিটিয়ে দেওয়া হয়। ডিক্রির শর্তগুলি কিন্তু আজও সবার অজানা।  

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Sarvapalli Radha Krishnan

আরো দেখুন