দেশ বিভাগে ফিরে যান

যুবসমাজকে ফোন সরিয়ে রেখে, দেশের অর্থনীতির বিষয়ে প্রশ্ন করতে হবে: চেতন ভগত

September 14, 2020 | 3 min read

(এই প্রতিবেদনটি দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়াতে প্রথম প্রকাশিত) 

যখন দেশ চরম অর্থনীতি দুর্যোগের সম্মুখীন, তখন দেশবাসীরা বলিউডের রহস্য মৃত্যুর সমাধানে ব্যস্ত। গত তিন মাসে জিডিপি ২৩.৯% হ্রাস পেয়েছে, যা এক অপ্রত্যাশিত, নজিরবিহীন এবং দেশের জন্যে ভয়ঙ্কর এক বিপদ।

করোনভাইরাস, ঈশ্বর, সরকারের ভুল নীতি নাকি সবকিছুর মিলিত প্রভাবে  এই ঘটনা ঘটল সেটা এই মুহূর্তে বিবেচ্য নয়। ঘটনাটি অনেকটা রান্নাঘরের ছিটিয়ে পড়ে থাকা এক বাটি দুধের মতো। আমরা  সারাদিন তর্ক করতে পারি, যে কেউ বাটিটি ফেলে দিয়েছিল কিনা, তা নিজে পড়ল কিনা বা কোন বিড়াল সেটা ফেলে দিয়েছে কিনা। কিন্তু মুল বিষয়টি হল ঘরে আর দুধ নেই, এবং  আমাদের সেটা আবার আনতে হবে। ঠিক সেভাবেই আমাদেরকেই আবার আমাদের দেশের  অর্থনীতিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। 

শেষ তিনমাস ছিল বিপর্যয়কর, কিন্তু এ বিপদও কেটে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এ বিষয়ে আমি আশাবাদী। হবেনা এরকমটা  বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। নোটবন্দির প্রত্যক্ষ প্রভাব মাত্র দুমাস স্থায়ী হলেও, তা দেশের অর্থনীতিকে বেশ কয়েক বছরের জন্যে গতিহীন করে দিয়েছিল। একইভাবে, জিডিপির এত বড় সঙ্কোচনে,  দেশে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার, চাকরি হ্রাস পাওয়ার, ব্যাংকের লোন দেওয়ার অক্ষমতার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। একবার কিছু ভেঙে গেলে তা জোড়া লাগে না। আমরা যদি এটা ধরে বসে থাকি যে ঈশ্বর এই সমস্যা তৈরি করেছেন, ঈশ্বরই ঠিক করে দেবেন সেটা বোকামো হবে। ঈশ্বর আমাদের মস্তিষ্ক দিয়েছেন, যা সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সমাধান বের করতে সক্ষম।

এই বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপটি হল সমস্যাটিকে স্বীকার করে নেওয়া। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে অর্থনীতির সঙ্কোচন আরো বেশি এটা প্রমাণ করতে পারলেই আমাদের সমস্যা মিটে যাবে না (যদিও কথাটি সত্যিও নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনও এরকম মারাত্মক, দীর্ঘ লকডাউন চলে নি)।  আমাদের দেশেই বিশ্বের সব থেকে কঠোর এবং দীর্ঘ লকডাউন চলে ( সবাই তখন বলেছিল, ‘কামাল কার দিয়া’ )। তবে জিডিপির এই ক্ষতি তারই পরিনাম। 

উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলি জানা উচিৎ ছিল। আমরা কখনোই ধনী দেশগুলির সাথে  প্রতিযোগিতা করতে পারি না। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দিনের শাটডাউন সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অতীতের করোনার ঘটনাগুলিই প্রমাণ করে যে এতো কঠোর লকডাউন অপ্রয়োজনীয় ছিল। হয়তো এটি কোন হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে – নিজেকে কষ্ট দিন এবং ঈশ্বর আপনার প্রতি সদয় হবেন। কষ্টের প্রতি এই ভালবাসার কারণেই আমাদের সপ্তাহান্তের লকডাউন, কারফিউ এবং অন্যান্য অযৌক্তিক বিষয়গুলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, যা রোগের থেকে বেশি দেশবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করার নেশা বলেই মনে হয়।

সমস্যাটিকে স্বীকার করে নেওয়ার পরে  দেশবাসীকে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে আমরা কি চাই? আমরা কি ধনী একটি দেশ হতে চাই? নাকি একটি শক্তিশালী দেশ? এসব কোনকিছুই এক ডজন প্লেন কেনা, বিজ্ঞাপন তৈরি করা বা উচ্চমানের জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় গান তৈরি করলেই হওয়া যায় না। এ সবকিছুই ভুয়ো এবং নির্বোধ কার্যকলাপ। এ সবই আত্মসম্মানবোধ না থাকার পরিচয়, যা ভারতীয়দের দীর্ঘকালীন সমস্যা। আমরা, ভারতীয়রা, নিজেদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ দেখাতে মরিয়া। দয়া করে এবার থামুন। আসল বিষয় হল ভারত একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হয়ে উঠছে। বিশ্বের ইতিহাসে কোনও দরিদ্র দেশকে কখনো সম্মান করা হয় না, তার ইতিহাস যতই দুর্দান্ত হোক না কেন, তা যতোই ঐতিহ্যশালী হোক না কেন, তার খাবার  যতোই সুস্বাদু হোক না কেন। আপনি ভারতের জন্য সম্মান চান? তাহলে ভারতকে ধনী হতে সহায়তা করুন।

অর্থাৎ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে আলোকপাত করতে হবে এবং ক্ষতিকর যে কোনও আচরণই নিন্দনীয়। কিন্তু আমরা করি ঠিক তার উল্টোটা। যেমন ধরুন, হিন্দু-মুসলিম বিষয়ক সামাজিক অস্থিরতা। যে দেশের মানুষেরা একে অপরকে ঘৃণা করে এমন দেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। আর একটি বড় সমস্যা হল আইন প্রণয়ন করে সরকার এবং বাবুদের প্রতিটি ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করার গভীর ইচ্ছা। মুক্ত অর্থনীতির কথা ভারত সরকার বোঝে না। অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করুন। 

এই সময়, স্বল্প মেয়াদে, সরকারের তরফে বড় পদক্ষেপ দরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে।   দরিদ্র জাতি হওয়ায়, কোন গর্ব থাকতে পারে না। দেশবাসীকেও সচেতন করতে হবে। এই মুহুর্তে, অদ্ভুতভাবেই আমাদের যুবসমাজ এইসব বিষয় নিয়ে বিশেষ পরোয়া করে না। একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম বেকার বা স্বল্প রোজগেরে হবে। হোয়াইট কলার কর্মীরা ডেলিভারি বয় হয়ে যাবে (যা ইতিমধ্যেই ঘটছে)। সাধারণ ভারতীয়রা আরও দরিদ্র হয়ে পড়বে এবং ধনী ও অভিজাতদের সেবা করবে। 

আমরা যেন আবার ১৯৮০ এর দশকে ফিরে যাচ্ছি। তার পরেও আমাদের যুবসমাজ সারাদিন তাদের ফোনে ব্যস্ত থাকছে, তাদের সস্তার ৪ জি ডেটা প্যাক শেষ করছে, বোকা বোকা ভিডিও দেখছে, ভিডিও গেম খেলছে, নীল ছবি দেখছে এবং সম্ভবত সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝগড়া করছে। দামি সময়ের অপব্যবহার। এসব তাদের জীবনের লক্ষ্য এবং জাতীয় সমস্যা থেকে তাদের সরিয়ে আনছে। সস্তা ডেটা আমাদের যুবসমাজকে অবরূদ্ধ করে রাখছে, এ যেন  সার্কাস দেখতে গিয়ে রাজ্য পোড়ানোর মতো ঘটনা। 

যুবকদের ফোন বন্ধ করে জেগে উঠতে হবে। তাদের স্বপ্ন, তাদের লক্ষ্য, তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থোপার্জনে মনোনিবেশ করতে হবে,  যাতে  ভারতীয় অর্থনীতিতে তাদেরও অবদান থাকে। প্রশ্ন করতে হবে –  অর্থনীতিতে আরো বেশি বৃদ্ধি কেন হচ্ছে না!

আমাদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা একে অপরের সাথে লড়াই করে স্বল্প- আয়ের কেরানী এবং ডেলিভারি বয় হয়ে দরিদ্র জাতি হয়ে থাকতে পারি, আবার আমরাই একটি ধনী জাতি হয়ে এবং বিশ্বে সম্মান অর্জন করতে পারি। আপনি কোনটার পক্ষে?

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Economy, #Chetan Bhagat

আরো দেখুন