বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

ব্যোমকেশ হয়েছেন যারা 

September 22, 2020 | 5 min read

গোয়েন্দা গল্প বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের। আর তাদের প্রিয় দুই গোয়েন্দা চরিত্র অবশ্যই ফেলুদা ও ব্যোমকেশ। একজনের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়, অপরজনের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের মধ্যে কে সেরা, এ নিয়ে যুগে যুগে বহু তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে। সেই যাই হোক এই দুই টিকটিকিই বাঙালির মনের অনেকখানি জায়গা জুরে আছে। 

চলুন দেখে নেওয়া যাক সেলুলয়েডে ব্যোমকেশ হয়েছেন কারাঃ 

উত্তম কুমার

১৯৬৭ সালে উত্তম কুমারকে ব্যোমকেশ আর শৈলেন মুখোপাধ্যায়কে অজিত চরিত্রে নিয়ে গোয়েন্দা গল্প থেকে ছবি নির্মাণে হাতেখড়ি হয়েছিল সত্যজিতের। চিড়িয়াখানা  নামক ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমার সেরা অভিনেতা, আর সত্যজিৎ সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।   

সতীন্দ্র ভট্টাচার্য

চিড়িয়াখানা বানানোর আগে স্টার প্রোডাকশন নামে যে প্রযোজনা সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেটি থেকেই ১৯৭৪ সালে আবার প্রযোজনা করা হয় ব্যোমকেশের নতুন ছবির। এবারের পর্বের নাম সজারুর কাঁটা। এ ছবিতে পরিচালকের খড়ম পায়ে গলালেন মঞ্জু দে। অজিতের ভূমিকায় সেই শৈলেন বন্দোপাধ্যায়ই, কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে উত্তম কুমারের স্থলাভিষিক্ত হলেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য।

অজয় গাঙ্গুলি

১৯৭৪ সালের সজারুর কাঁটার পর ব্যোমকেশ নির্মাণে কিছুটা ছেদ পড়েছিল। সবে ধন নীলমণি হিসেবে আশির দশকে দূরদর্শনের বাংলা সংস্করণ ডিডি বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল ব্যোমকেশ বক্সী নামে একটি সিরিজের বেশ কিছু পর্ব। সেখানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন অজয় গাঙ্গুলি। তবে এই সিরিজটিও পারেনি খুব বেশি দর্শকের মন জয় করতে। 

রজিত কাপুর

কিন্তু দূরদর্শনেই হিন্দিতে যখন জাতীয়ভাবে প্রচার শুরু হলো ব্যোমকেশ বক্সী, তা হয়ে উঠল তুমুল জনপ্রিয়। সেটি নব্বই দশকের কথা। খ্যাতিমান নির্মাতা বাসু চ্যাটার্জির পরিচালনায় সেই হিন্দি সিরিজে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন রজিত কাপুর। এছাড়া অজিত চরিত্রে দেখা যায় কে কে রায়নাকে, আর সত্যবতী চরিত্রে সুকন্যা কুলকার্নিকে। মোট দুই মেয়াদে প্রচারিত হয়েছিল এটি। ১৯৯৩ সালে প্রথম মেয়াদে ১৪ পর্ব, আর ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ২০ পর্ব।

সুদীপ মুখোপাধ্যায়

হিন্দি দূরদর্শনে ব্যোমকেশ বক্সী শেষ হওয়ার পর আবার বেশ কয়েক বছরের বিরতি। এরপর ২০০৪ সালে বাংলা দূরদর্শনে ফেরে ব্যোমকেশ বক্সী। স্বপন ঘোষালের পরিচালনায় ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন সুদীপ মুখোপাধ্যায়। এছাড়া অজিত ও সত্যবতী চরিত্রে যথাক্রমে দেবদূত ঘোষ ও মৈত্রেয়ী মিত্র। যথারীতি বাংলা টেলিভিশনে নির্মিত আগের সিরিজটির মতো এটিও ব্যর্থ হয় জনপ্রিয়তা লাভে। কারণ ততদিনে কলকাতায় চলে এসেছে বাংলা ভাষার বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল, আর সেগুলোর ধারাবাহিক নাটকে বুঁদ হতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ।

বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়

এরপরও হাল ছাড়েননি স্বপন ঘোষাল। ২০০৭ সালে তিনি আবারো হাজির হন ব্যোমকেশ বক্সী নামের টিভি সিরিজ নিয়ে। এবার অবশ্য দূরদর্শন নয়, তারা মিউজিকের জন্য তিনি নির্মাণ করেন সিরিজটি। সেখানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সত্যবতীর ভূমিকায় পিয়ালি মিত্র। বলাই বাহুল্য, এই সিরিজটিও দর্শকমনে দাগ কাটতে পারেনি।

শুভ্রজিত দত্ত

তারপর এলো স্বপন ঘোষালের মগ্ন মৈনাক। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বড় পর্দায় ফিরল ব্যোমকেশ! ব্যোমকেশের চরিত্রে শুভ্রজিত দত্ত। স্বপন ঘোষালের দুর্বল নির্মাণের সেই ব্যোমকেশকে গ্রহণ করল না বাংলার মানুষ। 

আবীর চট্টোপাধ্যায়

২০১০ সালে বড়পর্দায় মুক্তি পেল অঞ্জন দত্তের বহুল প্রতীক্ষিত ব্যোমকেশ বক্সী। মুক্তির আগেই যেভাবে দর্শকমনে আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল ছবিটি, তাতে করে মুক্তির পর দর্শক যে হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তা এক প্রকার অনুমিতই ছিল। কিন্তু যেটি অনুমিত ছিল না, তা হলো আবীর ছাড়াও, অজিত চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং সত্যবতী চরিত্রে ঊষসী চক্রবর্তী অভিনয় করা, আদিম রিপু গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিটি ঠিক এতটা ভালো হবে। 

সুজয় ঘোষ

২০১৪ সালে ব্যোমকেশ-ফেলুদা নিয়ে এত নাটকের আগেই অবশ্য বড়পর্দায় চলে এসেছিল নতুন আরেক ব্যোমকেশ। তিনি কাহানিখ্যাত সুজয় ঘোষ। আর পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রথম দফায় যে ব্যোমকেশকে নিয়ে ছবি করতে চেয়েও পারেননি, সেই ব্যোমকেশকে নিয়েই তিনি করেছেন তার জীবনের শেষ ছবি সত্যান্বেষী। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর পর। তিনি মারা যান ২০১৩ সালের ৩০ মে, আর সত্যান্বেষী মুক্তি পায় ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর। 

ঋতুপর্ণ মারা যাওয়ার আগেই সত্যান্বেষীর শুটিংয়ের সিংহভাগই শেষ করে গিয়েছিলেন। অবশিষ্ট যেটুকু ছিল, তা সম্পন্ন করেন দীর্ঘদিন তার ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করা অভিক মুখোপাধ্যায়। এই ছবিতে ব্যোমকেশ চরিত্রে সুজয় ঘোষ ছাড়াও অজিত হিসেবে অভিনয় করেছিলেন সংগীতশিল্পী ও পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।

গৌরব চক্রবর্তী

২০১৪ সালে টেলিভিশনে ফেরে ব্যোমকেশ। এবং এবার ব্যোমকেশ ফেলুদার ছেলে! মানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন সব্যসাচীর ছেলে গৌরব চক্রবর্তী। কালার্স বাংলা চ্যানেলে প্রচারিত হয় টিভি সিরিজটি। এটিও অনেকাংশে মূলানুসারী, কিন্তু অনেকটা টিভি সোপের মতো করে এখানেও অহেতুক কাহিনী টেনে বড় করার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। এই সিরিজে অজিতের ভূমিকায় ছিলেন সৌগত বন্দোপাধ্যায়, এবং সত্যবতী চরিত্রে রিধিমা ঘোষ। বিভিন্ন পর্বের পরিচালনা করেন অমিত সেনগুপ্ত, গোপাল চক্রবর্তী ও জয়দীপ মুখার্জী। আর সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে ছিলেন মৈনাক ভৌমিক।

যীশু সেনগুপ্ত

অঞ্জন-আবীর ব্যোমকেশ ফ্রেঞ্চাইজি ভেঙে যায়, আবীর হয়ে যায় অরিন্দম শীলের ব্যোমকেশ। এবার অঞ্জন খোঁজেন ব্যোমকেশ হিসেবে এক পরিচিত মুখ, কিন্তু যার কোনো আলাদা ইমেজ নেই। সেই চাওয়া মিলল যীশু সেনগুপ্তে। দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন যীশু। ছোটপর্দা-বড়পর্দা সবখানে কাজ করেছেন, কিন্তু কখনো টাইপকাস্ট হয়ে যাননি। সুতরাং তিনিই তো হতে পারেন অঞ্জনের নতুন ব্যোমকেশ। 

যীশুকে তো পাওয়া গেল ব্যোমকেশ হিসেবে, কিন্তু অজিত-সত্যবতী হবে কে? অঞ্জন চেয়েছিলেন নতুন ব্যোমকেশ এলে তার পাশাপাশি অন্য দুই চরিত্রেও পরিবর্তন আনবেন তিনি। কিন্তু শাশ্বত-ঊষসীর সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর তার মনে হলো, তা কেন, শাশ্বত-ঊষসীই তো সম্ভাব্য সেরা অজিত-সত্যবতী।

সুশান্ত সিং রাজপুত

ব্যাক টু ২০১৫। এ বছর মুক্তি পায় ব্যোমকেশকে নিয়ে নির্মিত প্রথম হিন্দি ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। বাংলা ব্যতীত আর সকল ভারতীয় ভাষায় নির্মাণের লক্ষ্যে ব্যোমকেশের সবগুলো কাহিনীর স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন পরিচালক দিবাকর ব্যানার্জি ও যশ রাজ ফিল্মস। এরপর যশ রাজ ফিল্মসের ব্যানারেই মুক্তি পায় ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী ছবিটি। এখানে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রে অভিনয় করেন সুশান্ত সিং রাজপুত।

ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়

২০১৫ সালে প্রবীণ ব্যোমকেশের দেখা মেলে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে। শৈবাল মিত্রর শজারুর কাঁটা ছবিতে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। তবে সাধারণ দর্শক খুব একটা সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি ছবিটিকে। এর পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পর্দায় বৃদ্ধ ব্যোমকেশকে সহ্য হয়নি অনেকের। দ্বিতীয়ত, ধৃতিমানের অভিনয় নিয়ে কোনো আপত্তি না থাকলেও, তার মাঝে ব্যোমকেশসুলভ বাঙালিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর তৃতীয়ত, শজারুর কাঁটা গল্পটিই প্রচলিত ব্যোমকেশ কাহিনীগুলোর চেয়ে অনেকটা আলাদা, যা দিয়ে একটি সফল চলচ্চিত্র বানানো বেশ কঠিন কাজ।

সুব্রত রায়

২০১৬ সালে মুক্তি পায় নীলোৎপল সিংহরায় পরিচালিত বরদা ও বহুরূপী  ছবিটি। শরদিন্দুর বহুরূপী গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রে দেখা যায় সুব্রত রায়কে। 

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

২০১৭ সাল থেকে হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে স্ট্রিম হচ্ছে ব্যোমকেশ  নামের ওয়েব সিরিজটি, যেখানে ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এছাড়া অজিত হলেন সুব্রত দত্ত (এবং সুপ্রভাত), এবং সত্যবতীর ভূমিকায় রিধিমা ঘোষ। সিরিজটির এখন পর্যন্ত পাঁচ সিজন পরিচালনা করেছেন সায়ন্তন ঘোষাল ও সৌমিক চট্টোপাধ্যায়। 

পরম্ব্রত চট্টোপাধ্যায়

ব্যোমকেশ ওয়েব সিরিজ, আলিনগরের গোলকধাঁধা ও যকের ধন সিরিজের সফল নির্মাতা সায়ন্তন ঘোষাল ২০১৯-এ বড়পর্দার জন্য নির্মাণ করেন ব্যোমকেশের নতুন ছবি। ব্যোমকেশের ভূমিকায় দেখা যায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে। ইতিপূর্বে ফেলুদা, তোপসে ও বিমল হিসেবে কাজ করা এই গুণী অভিনেতা এবার এলেন ব্যোমকেশ হিসেবে। মগ্ন মৈনাক গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয় সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ  ছবিটি।  

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Byomkesh Bakshi

আরো দেখুন