বাংলার অগ্রগতির ইতিবাচক তথ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টে
কর্মসংস্থান থেকে কৃষি উৎপাদন। বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ অথবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সম্প্রসারণ। অর্থনীতি ও প্রশাসনিক উন্নয়নের মাপকাঠির নিরিখে বিগত বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মঙ্গলবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে (হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিসটিকস অন ইন্ডিয়ান স্টেটস, ২০১৯-২০) এরকমই একঝাঁক ইতিবাচক তথ্য দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে। দেখা যাচ্ছে, দেশের সব রাজ্যের পারফরম্যান্সের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ বেশ কিছু ক্ষেত্রেই প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। ধান উৎপাদন কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো নির্মাণে রাজ্যের উন্নত অবস্থান সর্বজনবিদিত। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টের সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হল, বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশের বিচারেও বিগত আর্থিক বছরে ৯ নম্বরে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ।
ওই বিভাগে (ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস) ২০১৭-১৮ সালে বাংলা ছিল ১০ নম্বর স্থানে। নাগরিক কর্মসংস্থানে দেখা যাচ্ছে, বহু রাজ্যের থেকেই বাংলা এগিয়ে। বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান বাংলার শহরাঞ্চলে বেশি হয়েছে। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে বাংলায় ৪৯ জন কর্মহীন। মহারাষ্ট্র, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে এই কর্মহীনতা তুলনায় বেশি। ধান ও পাট উৎপাদনে দেশের মধ্যে সেরা তো বটেই, সামগ্রিক শস্য উৎপাদনেও প্রথম পাঁচটি রাজ্যের অন্যতম বাংলা। মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনে প্রথম তিনে। কৃষিতে বাংলার সাফল্যকে দীর্ঘকালই স্তিমিত করেছে শিল্পের শ্লথতা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই পরিসংখ্যান রিপোর্টে সেই শিল্পহীনতার অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে আলোকরেখা। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ছিল ৮ হাজারের কিছু বেশি বৃহৎ কারখানা। পরের ৯ বছরে সেই সংখ্যা দেড় হাজার বেড়েছে। বৃহৎ কারখানার সংখ্যা বাংলায় ৯৫৩৪টি।
তবে রাজ্য সরকারের অন্যতম প্রধান সাফল্য হল, পরিকাঠামো নির্মাণে ধনী ও বৃহৎ রাজ্যগুলিকে ছাপিয়ে যাওয়া। অর্থনীতির পরিভাষায় দু’রকম ব্যয় করে সরকার। ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার তথা মূলধনী ব্যয় এবং রেভেনিউ এক্সপেন্ডিচার অথবা রাজস্ব ব্যয়। প্রথম ক্ষেত্রটি বোঝায় পরিকাঠামো নির্মাণকে, যেমন সড়ক, সেতু, ভবন ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি কর্মীদের বেতন, পেনশন, সামাজিক খাতে খয়রাতি ইত্যাদি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচারে পশ্চিমবঙ্গের ব্যয় গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলির থেকে বেশি। ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে এই খাতে ৫২ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলা। সামাজিক উন্নয়ন খাতে ব্যয়ে প্রথম সারির পাঁচটি রাজ্যের মধ্যেই রয়েছে বাংলা।
অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে সাধারণত বৃহৎ কারখানা, উৎপাদন শিল্পকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সরকারের নানাবিধ উপহার এই কর্পোরেটই পেয়ে থাকে। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে মোদি সরকার সবথেকে বেশি জোর দিয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। আত্মনির্ভর প্যাকেজ থেকে শুরু করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকার লোন, সবকিছুরই ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশ বাকি সব রাজ্যকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ছাপিয়ে গিয়েছে। এ রাজ্যে ক্ষুদ্র শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৮৯ লক্ষ। উত্তরপ্রদেশে ৯০ লক্ষ। সবথেকে আশাব্যঞ্জক প্রভাব হল, ক্ষুদ্র শিল্পে বাংলায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ২০১৮-১৯ সালে। গুজরাতে হয়েছে ৬১ লক্ষ, মহারাষ্ট্রে ৯১ লক্ষ। একটি রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ চালিকাশক্তি হল, নিজস্ব কর আদায়। গত কয়েক বছরে বাংলার করসংগ্রহ অনেকটাই বেড়েছে। ৬৭ হাজার ২০৭ কোটি টাকার কর আদায় হয়েছে। সবই কি শুধুই ইতিবাচক তথ্য? একেবারেই নয়। মোট পুঁজির বিনিয়োগ, বৃহৎ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি লগ্নি, জনপ্রতি বিদ্যুতের ব্যবহার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলিতে এখনও অনেকটাই উন্নতি করতে হবে বাংলাকে প্রথম সারিতে যাওয়ার জন্য।