নবনীতা – এক দৃপ্ত বিদ্রোহী কণ্ঠ
‘তুমি সুস্থ হ’লেই ওরা আবার ফিরবে’
বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা দেব সেন আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন।
১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি হিন্দুস্তান পার্কের এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক দম্পতি নরেন্দ্র দেব এবং রাধারানী দেবীর কন্যা নবনীতা। শৈশব থেকে সাংস্কৃতিক পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। স্কুলের পাঠ শেষ করেন গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। উচ্চশিক্ষা লাভ করেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে তিনি বিশিষ্ট কবি বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য হন।
১৯৭৫- ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা এবং দীর্ঘ সময় যাবত বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন।
নবনীতা দেবসেনের প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়’। প্রথম উপন্যাস ‘আমি অনুপম’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। অজস্র পত্র-পত্রিকায় তাঁর বিপুল রচনা সম্ভার ছড়িয়ে রয়েছে। কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী এবং উপন্যাসে তাঁর সাবলীল লেখনী কয়েক প্রজন্মকে এখনও মন্ত্রমুগ্ধ করে চলেছে।
১৯৯৯ সালে আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা ‘নটী নবনীতা’ বইটির জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।