ভোটের আগে ‘গাজর’ ঝোলানো বিজেপির ট্র্যাডিশন
রাজ্য সরকারের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের কাছে কিষান সম্মান নিধি যে নাকের বদলে নরুন, তা চাষিদের কাছে দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এরাজ্যের সমস্ত চাষি পরিবার কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সুবিধা পান। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে কেবল প্রান্তিক চাষিরাই অনুদান পাওয়ার যোগ্য। ফলে বাদ পড়বে রাজ্যের অধিকাংশ কৃষক পরিবার। অথচ সেই প্রকল্প চালু না হওয়ায় বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই তুলোধোনা করছে। আর যে মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প চালুতে সম্মতি দিলেন সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্ব জানিয়ে দিল, এই প্রকল্প তারা সরকার বদলের পর চালু করবে। বোঝা গেল, মানুষের সামনে ‘গাজর’ ঝোলানোটা বিজেপির মজ্জাগত।
কেন বিজেপির রাতারাতি ভোলবদল? অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কিষান সম্মান নিধিতে যত চাষি অনুদান পেতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বাদ পড়তেন। তাতে বঞ্চিত চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতো। সেক্ষেত্রে বিজেপির লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতো। সেটা বুঝেই চাষিদের জন্য প্রকল্প চালু না করে বিজেপি তাকে মমতা বিরোধী প্রচারের হাতিয়ার করতে চাইছে। চাষিদের উপকার নয়, মমতার বিরোধিতাই তাদের আসল উদ্দেশ্য।
এবার দেখা যাক, যে সব রাজ্যে কিষান সম্মান নিধি চালু হয়েছে, সেখানে কী ঘটছে। সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে এক প্রশ্নের উত্তরে এই প্রকল্পে বিভিন্ন রাজ্যে কী হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে এসেছে। কৃষিমন্ত্রক জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি প্রকল্পে ১৩৬৪ কোটি টাকা ‘অপাত্রে’ দান করা হয়েছে। অনুদান পাওয়ার যোগ্য নয়, এমন অনেকেই এই টাকা পেয়েছেন। সেই সংখ্যাটা নয় নয় করে প্রায় সাড়ে ২০ লক্ষ। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাতেই রয়েছে প্রায় ১লক্ষ ৬৪ হাজার। বিজেপি শাসিত অসমেও একইভাবে ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার পরিবারকে টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। মজার কথা, এই বিজেপি নেতারাই পশ্চিমবঙ্গে এসে উম-পুনের ত্রাণবিলিতে দুর্নীতি হয়েছে বলে গলা ফাটান। কাচের ঘরে বসে ঢিল ছোঁড়ার অভ্যেসটা বিজেপি ভালোই রপ্ত করেছে। অবশ্য তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ সব সময় চালুনিই সূচের বিচার করে।
কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হাজার হাজার চাষি দিল্লির উপকণ্ঠে রাস্তায় বসে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁরা বুঝেছেন, চাষিদের মুখ চেয়ে নয়, কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন করেছে মজুতদার ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে। তার ফলে ডাল, ভোজ্যতেল সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। তার খেসারত সাধারণ মানুষকেই দিতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রের কৃষি আইনের উপর স্থগিতাদেশ দিতে বাধ্য হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দিন যত যাচ্ছে বিজেপির গায়ে ততই লেপ্টে যাচ্ছে ‘কৃষক বিরোধী’ তকমা। তাই বঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে বিজেপি এখন ‘কৃষক দরদি’র ভেক ধরতে চাইছে। কৃষকের মন পাওয়ার জন্য তাদের কত কিছু করতে হচ্ছে! ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণে বিজেপি মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা, বিবেকানন্দের বাণী আওড়াতে হচ্ছে। তাও ভুলভাল। বিজেপির ‘হাইপ্রোফাইল নেতারা’ বাউলশিল্পী, প্রান্তিক চাষির বাড়িতে মধ্যহ্নভোজ সারছেন। এমনকী, দিল্লি থেকে উড়ে এসে চাষিদের বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষে চাইছেন। আর সে সব হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমের সামনে। কারণ প্রচারটা ভীষণ জরুরি।
কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হয় পশ্চিমবঙ্গে। চাষিদের ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে এফসিআই দেশজুড়ে সহায়কমূল্যে ধান কেনে। পরিমাণটা দেশে উৎপাদিত ধানের ৪৩ শতাংশের কাছাকাছি। সেই অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১ কোটি ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন ধান সহায়কমূল্যে কেনার কথা। কিন্তু রাজ্যের তথ্য, কেনা হয়েছে মাত্র ৭৬ হাজার মেট্রিক টন। অথচ এই এফসিআই উত্তরপ্রদেশ থেকে ৭০ লক্ষ মেট্রিক টন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ৮২ লক্ষ মেট্রিক টন, তেলেঙ্গানা থেকে ১১১ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কিনেছে। এরপরেও রাজ্যকে বঞ্চিত করার অভিযোগ তোলাটা কি অযৌক্তিক?
লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে বিজেপির ১৮ জন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। যার অধিকাংশই কৃষি অধ্যুষিত এলাকা। চাষিরা অনেক আশা নিয়ে তাঁদের দু’হাত তুলে আর্শীবাদ করেছিলেন। কিন্তু বিজেপি সাংসদরা কি দিল্লিতে গিয়ে চাষিদের স্বার্থে একটিবার কোনও কথা বলেছেন? বিজেপির সাংসদরা ৩৫৬ ধারা জারির জন্য দল বেঁধে দিল্লি ছুটতে পারেন, কিন্তু রাজ্যের চাষিদের দাবি নিয়ে মুখে রা কাড়েন না। এটাই ট্র্যাডেজি।
বিজেপি নেতারা এরাজ্যে চাষি ধানের সহায়কমূল্য পাচ্ছেন না বলে দিনরাত তোপ দাগছেন। রাজ্যের চাষিরা যে সহায়কমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেটা একেবারে সত্যি কথা। এই ইস্যুতে একবার নয়, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে হাজারবার আঙুল তোলার অধিকার তাঁদের আছে। কিন্তু একটিবারও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও বেশি ধান কেনার দাবি কেন তাঁরা জানাচ্ছেন না? কেন্দ্র যদি এরাজ্য থেকে আনুপাতিকহারে সহায়কমূল্যে ধান না কেনে, চাষিরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন কী করে! ভাত দেওয়ার মুরোদ না থাকলে কিল মারার গোঁসাই হয়ে কী লাভ?
একথা হলফ করে বলতে পারি, সার, ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করলে ও চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পেলে তাঁদের ‘কৃষকবন্ধু’ বা ‘প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি’র প্রয়োজন হবে না। তখন আর ‘কৃষক দরদি’ বোঝানোর জন্য বিজেপি নেতাদের ডাইনিং টেবিল ছেড়ে কষ্ট করে দুয়ারে বসে ‘লাঞ্চ’ সারতে হবে না, মুষ্টিভিক্ষের নাটকও করতে হবে না।
ভোটের মুখে ‘গাজর’ ঝোলানোটা বিজেপির ট্র্যাডিশন। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমা ‘বেআইনি অর্থ’ ফিরিয়ে এনে প্রত্যেককে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল বিজেপি। ‘গাজর’ ঝোলানোর সেই শুরু। তারপর নোট বাতিল করে ‘কালাধন’ নিকেশের ‘গাজর’। জিএসটি চালু করে জিনিসপত্রের দাম কমানোর ‘গাজর’। বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির ‘গাজর’। নাগরিকত্ব দেওয়ার ‘গাজর’। ভোট এলেই ‘গাজর’ ঝুলিয়ে দেয় বিজেপি। বঙ্গে নির্বাচন আসন্ন। তাই এবার সোনার বাংলা ও কৃষি সম্মান নিধির ‘গাজর’।
সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘গাধার পিঠে বসল চেপে/মুলোর ঝুঁটি ঝুলিয়ে নাকে/ আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে?/ মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে/ দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে/ যতই চলে ধরব ব’লে/ ততই মুলো এগিয়ে চলে।’
সুকুমার রায়ের কবিতার মুলোই এখন রাজনীতির ‘গাজর’। গাজর ঝুলিয়ে গাধাকে বারবার বোকা বানানো যায়, কিন্তু মানুষকে নয়। কারণ মানুষ বোঝে, মুখের যত কাছেই গাজর থাকুক না কেন, তার নাগাল পাওয়া যায় না।