কার দোষে মুকুল ফিরলেন তৃণমূলে? বিজেপির অন্দরে দোষারোপ শুরু
বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না-উঠতেই বাংলায় ফের হোঁচট খেল BJP । অমিত শাহ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের ‘তুরুপের তাস’ মুকুল রায় এখন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে।
দলে পেয়েও মুকুল রায়ের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে পারেনি বিজেপি। বিধানসভা ভোটে মুকুল ব্রাত্যই ছিলেন গেরুয়া শিবিরে। ভোটের ফল ঘোষণার এক মাস ন’দিনের মাথায় আচমকা তিনি পুরোনো দল তৃণমূলে ফিরে যাওয়ায় কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে পদ্ম শিবিরের। রাজ্য বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার না-করলেও, দলের অন্দরে এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে মুকুল না-থাকলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন গেরুয়া-ঝুলিতে কিছুতেই আসত না। এহেন মুকুলকে কেন বিধানসভা ভোটে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছিল, তা নিয়ে বিজেপি -র বহু নেতাই ঘনিষ্ঠ মহলে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, মুকুল তৃণমূলে ফিরে যাওয়ায় বিজেপি -র নিচুতলার সংগঠনে বড়সড় ফাটল ধরতে চলেছে। কেননা, বুথস্তরে দলীয় কর্মীদের অনেকেই মুকুল-অনুগামী।
তবে ‘মুকুল হারানো’র যন্ত্রণা প্রকাশ করতে চাইছেন না বিজেপি নেতারা। হাবেভাবে তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, যেন কিছুই হয়নি। দিলীপ ঘোষের মতে, মুকুল তৃণমূলে চলে যাওয়ায় তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না। দলের তাত্ত্বিক নেতা স্বপন দাশগুপ্ত টুইট করে বলেছেন, ‘বাংলায় বিধানসভা ভোটে হারার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নতুন এবং পুরোনো নেতা-কর্মীদের ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই। বিজেপি -র ব্যাপ্তি বাংলায় আরও বাড়বে।’
রাজ্য BJP-র সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজমদারও এদিন বিকেলে দলের তরফে সাংবাদিক বৈঠকে কটাক্ষ করেছেন, ‘নতুন ইনিংসের জন্য মুকুল রায়কে অভিনন্দন। আশা করি, উনি দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি এবং বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলে গিয়েছেন। অথবা খুব তাড়াতাড়ি দেবেন।’
এ ছাড়াও সৌমিত্র খাঁ, বৈশালী ডালমিয়া, শীলভদ্র দত্তরা এদিন মুকুলকে আক্রমণ করে বার্তা দিয়েছেন যে তাঁদেরও তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। বারবার দলবদল মানুষ ভালো ভাবে নেয় না বলেই তাঁদের অভিমত। আবার ব্যারাকপুরের BJP সাংসদ অর্জুন সিং, যাঁর সঙ্গে মুকুল ও তাঁর পুত্র শুভ্রাংশুর সুসম্পর্ক সুবিদিত, তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ওঁকে যে বিশ্বাস করা যায় না, তা আমি দলের নেতৃত্বকে অনেকবারই বলেছি। আমার থেকে ওঁকে বেশি কেউ চেনে না।’
বাবুল সুপ্রিয় টুইট করেছেন, ‘ব্যাডমিন্টনের শাটল-এর মতো এদিক-ওদিক করার একটা বয়সও তো আছে, আত্মসম্মান ব্যাপারটা না হয় ছেড়েই দিলাম!’BJP-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা আবার এই সুযোগে নিজের দুঃখের কথা টুইট করে উল্লেখ করেছেন। কেন কাজের নেতাদের দলে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন টুইটে।
মুখে বিজেপি নেতারা গরম-গরম কথা বললেও, শুক্রবার দুপুর থেকে মুকুলের তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্র রীতিমতো ঝড় উঠে যায় বিজেপি -র অন্দরে। শুরু হয়েছে নিজেদের মধ্যে দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপের পালাও। রাজ্য BJP-র অন্দরে মুকুল-বিরোধীদের অভিযোগ, কৈলাস বিজয়বর্গীয় গোড়ায় মুকুল রায়ের উপরেই সংগঠনের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনিই দলের পুরোনো নেতাদের ব্রাত্য করে মুকুলকে ‘চাণক্য’র আসনে বসিয়েছিলেন কার্যত। ফলে মুকুলের তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার ঘটনায় যদি বিজেপি -র কোনও ক্ষতি হয়, তার দায় কৈলাসদেরই নিতে হবে।
উল্টো দিকে, বিজেপি -র অন্দরে মুকুলপন্থীদের পাল্টা যুক্তি, দিলীপ ঘোষরা মুড়ি-মুড়কির একদর ভেবেছিলেন। দলের চুনোপুঁটি নেতাদের সঙ্গে মুকুল রায়ের যে ফারাক আছে, সেটা মানতে চাননি তাঁরা। বিধানসভা ভোটে মুকুলকে অন্ধকারে রেখেই রণকৌশল ঠিক হয়েছিল। তার ফলেই এই নির্বাচনী ভরাডুবি। তাই সুযোগ বুঝে মুকুলও দল ছেড়ে দিয়েছেন।
মুকুলের দল ছাড়া নিয়ে বিজেপি -র কেন্দ্রীয় নেতারা কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে এদিন দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠকে মুকুল প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও জবাব দিতে চাননি। কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও ফোন তোলেননি সংবাদমাধ্যমের।
রাজ্য বিজেপি -র এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দলে আসার পর অমিত শাহরা ভুলেই গিয়েছিলেন মুকুলের কথা। এটা ভালো ভাবে নেননি উনি। আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে, অন্যান্য দলবদলুদের থেকে মুকুল সংগঠনটা অনেক ভালো বোঝেন।’
রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব একরকম নিশ্চিত যে মুকুলের পিছন পিছন আরও অনেক বিজেপি নেতা-কর্মী তৃণমূলের দিকে পা বাড়াবেন। সেই ধাক্কা সামলে ওঠাই এখন দিলীপ ঘোষদের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বিধানসভা ভোটের আগে BJP-র বিরুদ্ধে অন্য দল ভাঙানোর অভিযোগ উঠেছিল। এ বার বিজেপি-ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে সরব হওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু খোদ তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এদিন গেরুয়া শিবিরের সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে বলেছেন, ‘মুকুল নিজের ইচ্ছায় তৃণমূলে ফিরে এসেছেন। আমরা বিজেপি -র মতো দল ভাঙাই না।’
তৃণমূল ভবনে মুকুল নিজে এদিন জানিয়েছেন, তাঁর বিজেপি ছাড়ার কারণগুলি লিখিত ভাবে পরে প্রকাশ করবেন। সেই লিখিত বিবৃতি পড়ার অপেক্ষায় বিজেপি নেতারাও আছেন।