দেশ বিভাগে ফিরে যান

‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে’ ভারতের কোভিড বিপর্যয় প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায়

August 29, 2021 | 16 min read

২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার ছিল যথেষ্ট বিভাজক। মেরুকরণের আগুনে আরও ঘি ঢালতে মাঠে নেমেছিলেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একটি জনসভার মঞ্চ থেকে তিনি তৎকালীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের তোষণ করার অভিযোগ করেন। তাঁর দাবি, একটি বিজেপি বিরোধী একটি দল দ্বারা পরিচালিত সরকার হিন্দু শ্মশানের চেয়ে মুসলমানদের কবরস্থানে জন্য বেশি টাকা খরচ করে। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় একের পর কটাক্ষের বাণে বিরোধীদের বিদ্ধ করে তাঁর বক্তব্য যখন শিখরে পৌঁছায়, তিনি উপস্থিত জনতাকে প্রশ্ন করেন, “যদি কোনও গ্রামে কবরস্থান তৈরি করা হয়, সেখানে শ্মশানও তৈরি হওয়া উচিত?”

মন্ত্রমুগ্ধের মত মাঠজুড়ে একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, “শ্মশান, শ্মশান!”

আশা করি, দেশবিদেশের পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় ভারতের শ্মশানগুলোতে গণচিতা থেকে ভেসে ওঠা লেলিহান বহ্নিশিখার ছবি থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রসন্নই হয়েছে। আশা করি উনি খুশি যে দেশের কবরস্থান ও শ্মশানগুলি জনসংখ্যার সমানুপাতিক হারে, এমনকি ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বহন করেও, দক্ষতার সাথে কাজ করছে।

ভারতের ক্রমবর্ধমান কোভিড বিপর্যয় সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতকে আলাদা করে রাখা যাবে কি?” দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে কোভিডের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, পরিবর্তনশীল প্রজাতিগুলিকে আটকে রাখা সম্ভব নয়, তা স্বীকার করে নেওয়া হয় এই প্রতিবেদনে। পাঠকের মনে হতেই পারে, কয়েক মাস আগে যখন ইউকে কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তীব্র গতির সাথে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন এই প্রশ্ন কেন তোলা হয়নি? কিন্তু আদতে, ভারতবাসী হিসেবে আমাদের কি সত্যি ক্ষুন্ন হওয়ার অধিকার আছে? জানুয়ারি মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন, ভুলে গেলে চলবে না!

মোদী এই বক্তব্য এমন সময় রাখেন, যখন ইউরোপ এবং আমেরিকার অধিকাংশ জনতা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করছিলেন। তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো তো দূর, এই মঞ্চকে মোদী আত্মস্তুতির জন্য ব্যবহার করেন। ভারতের কোভিড মোকাবিলা ও পরিকাঠামো গঠনের ঢাক পেটাতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।  আমি সেই বক্তৃতাটি ডাউনলোড করে রেখেছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল, যখন মোদী-তন্ত্রের সেনানীরা নতুন করে ইতিহাস রচনা করবেন, যা অনতিবিলম্বেই সম্ভব, এই বক্তৃতাটি হারিয়ে যেতে পারে। ফলে সেটি খুঁজে পাওয়া হয়ে উঠবে দুষ্কর। সেই বক্তব্যের কিছু অমূল্য রত্ন তুলে ধরলাম:

“বন্ধুগণ, এই আশঙ্কার পরিস্থিতিতে আমি ভারতের ১৩০ কোটি জনতার তরফে আশা, ভরসা এবং ইতিবাচক মনোভাবের বার্তা বহন করে এনেছি। এমন অনেক ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল যে করোনার দাপটে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হতে পারে ভারত। দাবি করা হয়েছিল, ভারতে করোনা সংক্রমণের সুনামি দেখা দেবে। এই বলা হয়েছিল, ভারতে অন্তত ৭০-৮০ কোটি মানুষ সংক্রমিত হবেন এবং ২০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করবেন।”

“বন্ধুগণ, ভারতের সাফল্য অন্য কোনও দেশের সাথে তুলনা করাটা ঠিক হবে না। বিশ্বের ১৮% মানুষ যে দেশের বাস করেন, সেই ভারত দেশ মানবতাকে এক বিরাট বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে করোনাভাইরাসকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।” করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে মানবতাকে রক্ষা করার কৃতিত্ব নিলেন জাদুকর মোদী। এখন যদিও প্রমাণিত যে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের দরজা আমাদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহু ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যে ‘তেজস্ক্রিয়’ বস্তুর মত ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের অভিযোগ করা কি সাজে? যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দল, আর ঘৃণা ও অবৈজ্ঞানিক মূর্খতার যে রাজনৈতিক আদর্শে তিনি বিশ্বাসী, এই রোগকে আরও প্রশমিত করছে, সেই দেশের মানুষ হয়ে আমরা কোন মুখে অভিযোগ করতে পারি?

উত্তর প্রদেশের কোভিড এ মৃতদের শ্মশান
ছবি সৌঃ article-14.com

কোভিডের প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ার পর গত বছর যখন স্তিমিত হয়ে গেল, তারপর সরকার এবং তাঁর স্তাবকতা করা কিছু ভাষ্যকার ‘বিজয় উৎসবে’ মেতেছিলেন। “ভারতে পিকনিক হচ্ছে না ঠিকই,” টুইট করেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য প্রিন্টের প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত। “কিন্তু আমাদের ড্রেনে মৃতদেহ উপচে পড়ছে না, হাসপাতালে শয্যার আকাল নেই, শ্মশান বা কবরস্থানে কাঠ কিংবা জায়গার অভাব নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না? অসহমত হলে তথ্য দিয়ে প্রমাণ করুন। যদি না আপনি নিজেকে ভগবান মনে করেন।” ওনার বর্ণিত এই নিষ্ঠুর, অসম্মানজনক ছবি যদি আমরা উপেক্ষাও করি, যে কোনও অতিমারীর একটি দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে, এই সহজ সত্যটাও কি আমাদের ভগবান এসে বলে দেবেন?

এই দ্বিতীয় ঢেউ প্রত্যাশিত ছিল। যদিও এর তীব্রতা বিশেষজ্ঞদের, এবং ভাইরোলজিস্টদের, হতবাক করে দিয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, যে কোভিড-কেন্দ্রিক পরিকাঠামো এবং ‘গণ আন্দোলন’ এর কথা বড়াই করে মোদী নিজের বক্তৃতায় বলেছেন, সেটি কোথায়? হাসপাতালে শয্যা নেই। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়বেন। বন্ধুরা ফোন করে আতঙ্কের কথা শোনাচ্ছে – হাসপাতালের ওয়ার্ডে যথোপযুক্ত স্টাফ নেই, জীবিতের চেয়ে বেশি মৃত রোগীর দেখা মিলছে সব জায়গায়। হাসপাতালের অলিন্দ হোক, কিংবা রাজপথ অথবা নিজেদের বাড়ি – মানুষ ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। দিল্লির শ্মশানগুলিতে শেষকৃত্যের জন্য কাঠ অমিল। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে কাঠের যোগানের জন্য শহরের গাছ কাটার বিশেষ অনুমতি দিয়েছে বন দপ্তর। প্রিয়জনের শবদাহের জন্য যে কোনও জ্বালানি ব্যবহার করতে প্রস্তুত মরিয়া আত্মীয়েরা। এমনকি উদ্যান ও গাড়ি পার্কিংয়ের নিষদিষ্ট জায়গাগুলিকেও ব্যবহার কর হচ্ছে মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য। পরিস্থিতি এতটাই গম্ভীর, মনে হচ্ছে যেন কোনও ইউএফও এসে শহরের ফুসফুস থেকে সমস্ত বায়ু নিঃশেষ করে শুষে নিয়েছে। একদম কোনও অজানা বিমান হামলার মত।

ভারতের এই অস্বাস্থ্যকর নতুন স্টক এক্সচেঞ্জে অক্সিজেন যেন নতুন মুদ্রা। প্রবীণ নেতা থেকে সাংবাদিক, আইনজীবী – সমাজের অভিজাত শ্রেণীর সদস্যরা – সকলেই টুইটারে অক্সিজেনের যোগান এবং হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা করার উদ্দেশে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ করছেন। অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্ল্যাক মার্কেটের রমরমা। অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেশিন আর প্রয়োজনীয় ওষুধের হাহাকার দেশজুড়ে।

এরই মধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে আরেক ব্যবসা। খোলা বাজারের সবচেয়ে নিচুস্তরে দৃশ্যটি এরকম – হাসপাতালের মর্গে নিজের প্রিয়জনকে শেষবারের মত দেখতে পাওয়ার অধিকারের জন্য দিতে হচ্ছে ঘুষ। শেষকৃত্যের মন্ত্রটা বলার জন্য পুরোহিতকে দিতে হচ্ছে উৎকোচ। সাধারণ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শের জন্য গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন অনলাইন প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারদের হাতে প্রতারিত মরিয়া মানুষজন। আর একদম ওপরের স্তরে, হয়তো আপনাকে নিজের জমিজমা, ঘটিবাটি বিক্রি করে কপর্দকশূন্য হয়ে কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। শুধুমাত্র চিকিৎসা শুরু করার জন্য যা ডিপোজিট চাওয়া হচ্ছে, তা আপনার পরিবারের বহু প্রজন্মের সঞ্চয়টুকুও নিঃশেষ করে দেবে। 

এত বাক্যব্যয় করেও হয়তো আমি এই সঙ্কটের গভীরতা ও এই বিপর্যয়ের উপক্ষয়ের বর্ণনা পুরোপুরি করতে পারলাম না। মানুষকে যে পরিমান  অব্যবস্থা ও অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার প্রিয় বন্ধু ‘টি’ এর সাথে যা হয়েছে, তা হয়তো দিল্লির এই মহা জনসমুদ্রে ক্ষুদ্র বিন্দু মাত্র। কুড়ির কোঠায় টি-এর বয়স। গাজিয়াবাদে নিজের মা-বাবার সাথে একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে সে। তারা তিনজনই কোভিড আক্রান্ত হয়, টি-এর মায়ের অবস্থা ছিল সঙ্কটজনক। যেহেতু তখন স্বে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তাই মায়ের জন্য হাসপাতালে বেড পেতে অসুবিধা হয়নি তার। টি-এর বাবা ছিলেন বাইপোলার ডিপ্রেশনের রোগী। তিনি হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠলেন এবং নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে থাকলেন। ঘুমাতে পারতেন না তিনি। অনলাইনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল তার। কিন্তু সম্প্রতি কোভিড সংক্রমণে নিজের স্বামীকে হারিয়ে তিনিও ভেঙে পড়ছিলেন মাঝেমাঝেই। তার মতে, টি-এর বাবাকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন। কিন্তু, কোভিডের কারণে সেটাও সম্ভব নয়। ফলে, রাতের পর রাত বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয় টি-কে। বাবার পাশে থেকে তাকে প্রতিহত করতে হয়, শুশ্রুষা করতে হয়, তার নোংরা পরিষ্কার করতে হয়। টি-এর সাথে কথা বলতে গেলে আমার গলা ধরে আসতো। শেষ পর্যন্ত যার ভয় পাচ্ছিলাম তাই হল। টি-এর বাবা মারা গেলেন। তিনি কোভিডে মারা যাননি। অসহায় পরিস্তিতির কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। ফলে তার ব্লাড প্রেসার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। মৃতদেহের কী হবে? আমার পরিচিত সকলকে মরিয়া হয়ে ফোন করতে শুরু করলাম আমি। বিশিষ্ট সমাজকর্মী হর্ষ মন্দরের এক সহকর্মী অনির্বাণ ভট্টাচার্য আমার ডাকে সাড়া দেন। ২০১৬ সালে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিবাদ সভা আয়োজন করার দোষে অনির্বাণের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা চলছে। গতবছর কোভিডের সঙ্গে যুঝে হর্ষও পুরোপুরি সুস্থ হননি এখনও। মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ২০১৯ সালে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার সুবাদে তাকেও গ্রেপ্তারির ভয় দেখানো হচ্ছে। হর্ষ যে অনাথ আশ্রমগুলো চালান, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সদর্থক ভূমিকার অভাবের ফলে হর্ষ এবং অনির্বাণের মত বিশিষ্টজনেরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হেল্পলাইন চালানো থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, এমনকি শেষকৃত্য এবং মৃতদেহ পরিবহনের দায়িত্বও পালন করছেন তাঁরা। এই কাজগুলি করা এই স্বেচ্ছাসেবকদের জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকারক সিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু এই অতিমারীর এই ঢেউয়ে কমবয়সীরাই সবচেয়ে সংক্রমিত হয়েছে, আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন তাঁরা। যখন যুবসমাজ মৃত্যুবরণ করে, তখন প্রবীণদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা কিছুটা হলেও কমে যায়।

দিল্লী হাসপাতালে মৃত এক করোনা রোগী
ছবি সৌঃ reuters.com

একদিন ঝড় থেমে যাবে। পৃথিবী আবার হবে ঠিকই। কিন্তু সেইদিন দেখার জন্য আমরা কতজন বেঁচে থাকবো তা বলা মুশকিল। বিত্তশালী শ্রেণী স্বস্তির নিঃশাস ফেলবে। গরিবেরা পারবে না। আপাতত, সংক্রমণ বা মৃত্যুর পরিসংখ্যানে কিছুটা হলেও সামঞ্জস্য আছে। রোগের নাগপাশ ধনী ব্যক্তিদের রেহাই দেয়নি। হাসপাতালে অক্সিজেনের আকাল। কোথাও আবার ‘নিজের অক্সিজেন নিজে আনো’ পরিকল্পনাও চালু হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে তীব্র, অশোভন লড়াই শুরু হয়েছে। আর নিজেদের দোষ ঢাকতে রাজনৈতিক দলগুলি তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। 

গত ২২ এপ্রিল, দিল্লির সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতাল গঙ্গা রামে কোভিড আক্রান্ত ২৫ জন সঙ্কটজনক রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যান। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহুবার মরিয়া বার্তা দিয়েছে। একদিন পর, হাসপাতাল বোর্ডের প্রধান চাপে পড়ে বয়ান দেন, “অক্সিজেনের অভাবেই যে এই রোগীদের মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না।” ২৪ এপ্রিল দিল্লির আরেকটি বড় হাসপাতালে জয়পুর গোল্ডেনে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতেই ২০ জন রোগী প্রাণ হারান। সেই একই দিনে দিল্লি হাই কোর্টে ভারতের সলিসিটর জেনারেল সরকারের পক্ষ থেকে বলেন, “অযথা অভিযোগ করে লাভ নেই… এখন অবধি আমরা নিশ্চিত করেছি যেন দেশের কোনও নাগরিকের অক্সিজেনের অভাব না হয়।”

উত্তরপ্রদেশের গেরুয়া বসনধারী মুখ্যমন্ত্রী অজয় মোহন বিষ্ট, যিনি যোগী আদিত্যনাথ নামেও পরিচিত, ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তাঁর রাজ্যে কোনও হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি নেই। যারা গুজব রটাবে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা হবে এবং তাদের জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হবে।

যোগী আদিত্যনাথ কিন্তু মশকরা করছিলেন না। হাথরাস জেলায় একটি দলিত মেয়ের গণধর্ষণ ও হত্যার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান গ্রেপ্তার হন উত্তরপ্রদেশে। তিনি কোভিড আক্রান্ত এবং সঙ্কটজনক অবস্থায় আছেন। সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে  তাঁর স্ত্রীর আর্ত নিবেদন, মথুরার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পশুর মত তাঁকে বেডের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। (সুপ্রিম কোর্ট সিদ্দিক কাপ্পানকে উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লির হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিয়েছে)। উত্তর প্রদেশে যারা বাস করেন, তাদের স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে – মরলে মর, ছড়িয়ো না।

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেই হুমকি – এই সংস্কৃতি উত্তরপ্রদেশে সীমাবদ্ধ নয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর এক মুখপাত্রের বক্তব্য, ‘ভারত বিরোধী’ কিছু ব্যক্তি ‘নেতিবাচক মনোভাব’ ও ‘অবিশ্বাস’ এর মাধ্যমে এই বিপর্যয়ে ঘি ঢালছেন। সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি আবেদন জানান, ইতিবাচক পরিবেশ’ তৈরি করতে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে। প্রসঙ্গত, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য আরএসএসের সাথে যুক্ত ছিলেন। এমনকি এই সংগঠন একটি সশস্ত্র বাহিনীও তৈরি করেছে। বলাই বাহুল্য, এই আবেদনের পরপরই সরকারের সমালোচনা করে এমন অনেক টুইটার হ্যান্ডেল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তাহলে কোথায় আমরা সান্ত্বনা পাব? বিজ্ঞানমনস্কতা খুঁজব? শুধুই তথ্যের বিচার করব? মৃতের সংখ্যা, সুস্থ রোগীর সংখ্যা, সংক্রমিতের সংখ্যা? ঢেউ শিখরে কবে পৌঁছাবে? ২৭ এপ্ৰিল দেশে ৩২৩,১৪৪টি নতুন কেস পাওয়া গেছে, ২৭৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা কি আমাদের স্বস্তি দেবে? সত্যি কি এই তথ্য নির্ভুল? করোনার টেস্ট করানো খুবই কঠিন, এমনকি দিল্লিতেও। শহর-শহরতলির বিভিন্ন শ্মশান ও কবরস্থানে কোভিডবিধি মেনে যতগুলো শেষকৃত্য হয়েছে, সেই হিসেবমত সরকারি পরিসংখ্যানের প্রায় ৩০গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে আমাদের দেশে। মেট্রো শহরগুলির চৌহুদ্দির বাইরে যে সব হাসপাতাল আছে, সেখানে কর্মরত ডাক্তাররা আপনাদের হয়তো সঠিক বাস্তবের সাথে পরিচয় করাতে পারবেন।

দিল্লিই যদি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে, তাহলে ভাবুন বিহার, উত্তরপ্রদেশ কিংবা মধ্যপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে কী অবস্থা। বিপর্যয়ের সময় পরিবারকে পাশে পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক শহর ছেড়ে, ভাইরাস বহন করে বাড়ির উদ্দেশে চলেছেন। ২০২০ সালে মোদীর অপরিকল্পিত লকডাউনের স্মৃতি আজও তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে অত্যন্ত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ফলে, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। টাকাকড়ি নেই, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই। পরিবহন বন্ধ। অনেকেই পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। পথে প্রাণ হারান শয়ে শয়ে মানুষ।  

এবারে অবশ্য দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। পরিবহন ব্যবস্থাও সচল। ট্রেনে-বাসে করে শ্রমিকরা নিজেদের ভিটে গ্রামে ফিরে গেছেন। দেশের অর্থনীতির ধারক ও বাহক তাঁরা, কিন্তু ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন কারণ তাঁরা জানেন যে কোনও বিপর্যয়ের সময় প্রশাসনের চোখে তাঁরা অস্তিত্বহীন। এবছর অবশ্য এই ‘মহাপ্রস্থানের’ ফলে দেখা দিয়েছে অন্য সমস্যা। নিজেদের গ্রামে ফিরে  যাওয়ার পর সেখানে ছিল না কোনও কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। ভাইরাসের সংক্রমণ যাতে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের তরফে ছিল না কোনও দেখনদারিও। 

এইসব গ্রামে ডায়েরিয়া আর টিউবারকুলোসিসের মত সহজেই চিকিৎসাযোগ্য রোগে প্রাণ হারান মানুষ। সেখানে কোভিডের মোকাবিলা হবে কী করে? কোভিড টেস্টার ব্যবস্থা আছে সেখানে? হাসপাতাল আছে? অক্সিজেন পাওয়া যায়? সবচেয়ে জরুরি, দরকারে অনুরাগের ছোঁয়াও কি পাওয়া যায়? ভালোবাসা ছাড়ুন, উদ্বেগও কি আছে? না নেই। কারণ ভারতের সমষ্টিগত হৃদযন্ত্রের জায়গায় বিরাজ করে কেবল চরম ঔদাসীন্য-পূর্ণ একটি হৃদয়-আকৃতির ফাঁপা গর্ত।

২৪ এপ্রিল জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতেই ২০ জন রোগী প্রাণ হারান
ছবি সৌঃ theweek.in

২৮ এপ্রিল সকাল সকাল দুঃসংবাদ পেলাম যে আমাদের বন্ধু প্রভুভাই আর নেই। মারা যাওয়ার আগে কোভিডের কিছু উপসর্গ দেখা গেছিল তাঁর শরীরে। কিন্তু কোভিড-মৃত্যুর পরিসংখ্যানে তাঁকে গোনা হয়নি কারণ কোনও পরীক্ষা বা চিকিৎসা ছাড়াই তিনি বাড়িতে মারা গেছেন। নর্মদা উপত্যকায় বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। বহু দশক আগে, বাঁধ নির্মাণকারী কর্মী ও অফিসারদের কলোনি তৈরির জন্য যখন প্রথমবার আদিবাসী ভূমিসন্তানদের বাস্তুচ্যুত করা হয়, কেওয়ারিয়ায় তাঁর বাড়িতে আমি অনেকবার আতিথ্যগ্রহণ করেছি। প্রভুভাইয়ের মত বহু পরিবার এখনও কলোনির সীমানাতেই বাস করেন। বাস্তুহীন, হতদরিদ্র এই পরিবারগুলি নিজভূমেই আজ পরবাসী।

কেওয়ারিয়াতে কোনও হাসপাতাল নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের আদলে সেখানে একটি ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ গড়া হয়েছে। ১৮২ মিটার উঁচু লম্বা বিশ্বের উচ্চতম এই মূর্তিটি গড়তে খরচ হয়েছে ৪২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একটি দ্রুতগতির লিফ্ট পর্যটকদের নর্মদা বাঁধের উচ্চতা থেকে সর্দার প্যাটেলের বুক পর্যন্ত নিয়ে যায়। নদী উপত্যকা বিস্তৃত যে সভ্যতা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেটি অবশ্য এখান থেকে দেখা যাবে না। বাঁধের জলে ভেসে যাওয়া গণ আন্দোলনের কাহিনীও লুপ্তপ্রায় আজ। বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের দরবারে যে অনন্য নজির এই মানুষগুলি সৃষ্টি করেছিলেন, নতুন করে সংজ্ঞা রচনা করেছিলেন মানব সভ্যতার, সেই আখ্যানও হারিয়ে গেছে নদীর জলের গভীরতায়। ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয় মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প এই মূর্তিটির।

প্রভুভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ দিতে যে বন্ধু আমায় মেসেজ করেছিলেন, তিনিও বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা। তিনি লেখেন, “এই মেসেজ লিখতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে। কেওয়ারিয়া কলোনির আশেপাশে কোভিড পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।”

ভারতের কোভিড গ্রাফ রচিত হয়েছে যে সুনির্ধিষ্ট সংখ্যাগুলির জোরে, সেগুলি অনেকটাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের সময় আমেদাবাদে নির্মিত দেওয়ালের মত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতে আসেন। তাঁর যাত্রাপথের বস্তিগুলো ঢেকে ফেলতে এই দেওয়াল নির্মাণ। সেরকমই, কোভিড পরিসংখ্যানের এই নম্বরগুলো স্রেফ সেই ভারতের যাদের অস্তিত্ব প্রশাসনের চোখে পড়ে। বাকি ভারতবর্ষ যেন ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। বর্তমান ভারতে, নাগরিকদের বলা হয় হিন্দু হিসেবে ভোট দিতে। কিন্তু তারা মারা যায় খোলামকুচির মত।

“অযথা অভিযোগ করবেন না।”                  

দেশে যে অক্সিজেনের ঘাটতির সম্ভাবনা আছে সেটা ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এবং সরকারের তৈরি একটি কমিটি নভেম্বর মাসেই আভাস দিয়েছিল। এই সামান্য তথ্য সম্পর্কেও আমাদের অভিযোগ করা উচিত নয়, তাই না? দিল্লির তাবড় তাবড় হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনও প্লান্ট নেই কেন, সেটাও জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, তাই না? প্রধামন্ত্রী জাতীয় বিপর্যয় তহবিলের বদলে গঠন করা পিএম কেয়ার্স ফান্ড – যা আদতে একটি অস্বচ্ছ সংস্থা – সাধারণ নাগরিকের টাকা ও সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহার করে ঠিকই কিন্তু ভাবখানা বেসরকারি সংস্থার মত, কোনও মানুষের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই। হঠাৎ করেই এই পিএম কেয়ার্সের টাকা অক্সিজেন সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এবার কি তাহলে আমাদের বায়ু সরবরাহেও মোদী শেয়ার কিনবেন?

“অযথা অভিযোগ করবেন না।”

স্ট্যাচু অফ ইউনিটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
ছবি সৌঃ theweek.in

আমাদের বুঝতে  হবে, মোদী সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে বেশ কিছু অন্য ইস্যু। পাবে নাই বা কেন? গণতন্ত্রের সর্বশেষ চিহ্নটুকুও ধ্বংস করা, অ-হিন্দু সংখ্যালঘু নাগরিকদের ওপর অত্যাচার, হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের ভিত আরও মজবুত করা – এগুলি যথেষ্ট কষ্টসিদ্ধি কাজ বটে। যেমন, অসমে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী ২০ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করে রাখার জন্য কয়েদখানা নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি কাজ। (এই বিষয়ে দেশের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট কড়াভাবে জানিয়ে দেয় তাঁরা সরকারের পাশেই আছেন)।

গতবছর মার্চ মাসে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংঘটিত মুসলিম-বিরোধী হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক অভিযুক্ত হিসেবে শত শত ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণ মুসলিম নাগরিক বিচারাধীন। তাদের নিজেদের সম্প্রদায়েরবিরুদ্ধে সংগঠিত একটি অপরাধের জন্য কারাবাস করতে হচ্ছে তাদেরই। আপনি যদি ভারতীয় মুসলিম হন, তাহলে আপনার খুন হওয়াটাও অপরাধ। আপনার পরিজনদের এর মাশুল চোকাতে হবে। অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের শিলান্যাস করা হল। যে স্থানে আগে একটি মসজিদ ছিল সেখানেই মন্দির নির্মিত হচ্ছে। প্রবীণ বিজেপি নেতাদের তত্ত্বাবধানে একদল আগ্রাসী হিন্দু ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল এই মসজিদটি। (এই বিষয়ে, আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট কড়াভাবে জানিয়ে দেয় তাঁরা সরকারের পাশেই আছেন এবং বকলমে আগ্রাসীদের পক্ষও নেন)। কৃষিকাজের বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে বিতর্কিত কৃষি আইন পাশ করানোও জরুরি ছিল। প্রতিবাদ করার জন্য রাস্তায় নামার দোষে লক্ষ লক্ষ কৃষককে মারধর করা এবং টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ার প্রয়োজনও ছিল।

তাছাড়া, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন দিল্লির ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে পড়া  সাম্রাজ্যবাদী প্রাণকেন্দ্রের চাকচিক্য ফেরানোর গুরুদায়িত্বও তো ছিল। নতুন হিন্দু ভারতের সরকার পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনে বসে কাজ করবে, তা কখনও হতে পারে? অতিমারীর কোপে বিধ্বস্ত দিল্লি যখন লকডাউন করা হল, তখন এই ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নির্মাণকে ‘অপরিহার্য পরিষেবা’ ঘোষণা করে কাজ শুরু হল। শ্রমিকদের স্থানান্তরিত করে এখানে আনা হল। আশা করি, মূল নকশায় বদল করে একটা শ্মশানও যোগ করা হবে। 

কুম্ভ মেলার আয়োজন করাটাও জরুরি ছিল, যাতে উত্তর ভারতের একটি ছোট শহরে কাতারে কাতারে হিন্দু ভক্তরা একত্রিত হয়ে গঙ্গাস্নান করতে পারেন। আর তারপর ভাইরাস বহন করে নিয়ে নিজের বাড়ি কিংবা শহরে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারেন। কুম্ভ মেলা চলতেই থাকবে। যদিও, মোদীবাবু খুব বিনয়ের সাথে প্রস্তাব দিয়েছেন গঙ্গাস্নান প্রতীকীভাবে সংগঠিত করা হোক। এর মানে কী, কেউ জানে না। 

(অবশ্য গত বছর তাবলীগি জামাতে আগত পুণ্যার্থীদের বিরুদ্ধে যেভাবে সংবাদমাধ্যম কার্যত প্রচার চালিয়েছিল, এমনকি তাদের যেভাবে ‘করোনা জিহাদি’ তকমা দেওয়া হয়েছিল আর দাবি করা হয়েছিল তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত করেছেন। কুম্ভ মেলার পুণ্যার্থীদের অবশ্য সেই তকমা জোটেনি।) হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী, যারা গণহত্যা থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছিলেন, তাদেরও মায়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া জরুরি কাজ। তাও আবার যখন সেই দেশে অভ্যুত্থান চলছে। (অবধারিতভাবে, যখন এই বিষয়ে আমাদের স্বাধীন সুপ্রিম করতে এই সংক্রান্ত মামলা দাখিল করা হয়, তাঁরা সরকারের সাথে সহমত পোষণ করেন।)

বলাই বাহুল্য, সরকার খুবই ব্যস্ত ছিল।

এইসব জরুরি কাজ ছাড়াও আরেকটা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করা। এর জন্য আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মোদীর কাছের মানুষ অমিত শাহ, নিজের মন্ত্রকের সব দায়িত্ব ভুলে মাসের পর মাস মনোনিবেশ করছিলেন শুধুমাত্র বাংলার ওপর। গ্রামেগঞ্জে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজের দলের হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রচার করাটাই ছিল লক্ষ্য। ভূগোলের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোট রাজ্য। এখানে একদিনেই নির্বাচন করা যেত, যেমনটা হয়ে এসেছে অতীতে। কিন্তু যেহেতু বাংলার মাটি বিজেপির কাছে এখনও দুর্জয় ঘাঁটি, তাই অন্য রাজ্য থেকে ক্যাডারদের নিয়ে এসে বিভিন্ন কেন্দ্রে ছড়িয়ে দিয়ে ভোট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন সময়ের। তাই, নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে আট দফায় ভাগ করা হল, যা চলল প্রায় এক মাস ধরে। শেষ দফার ভোট হল ২৯ এপ্রিল। দেশজুড়ে যখন করোনা গ্রাফ উর্ধমুখী, তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করে আট দফার বদলে দ্রুত এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। সব দাবি খারিজ করে কমিশন বেনজিরভাবে বিজেপির পাশে দাঁড়ায়, প্রচারও চলতে থাকে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের ভিডিও সকলেই দেখেছেন। বিজেপির ‘তারকা প্রচারক’ তিনি। মাঠভর্তি মাস্কহীন মানুষের সামনে নিজেও মাস্ক ছাড়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি এই বিপুল জনসমাগমের জন্য ধন্যবাদ জানালেন আগত মানুষকে। এই জনসভাটি হয়েছিল ১৭ এপ্রিল, যেদিন দেশের করোনা সংক্রমণের সংখ্যা সব রেকর্ড ভেঙে ২ লক্ষের মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছিল।   

যতদিনে নির্বাচন শেষ হল, বাংলায় যেন করোনার আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ল। এমনকি একটি নতুন ট্রিপল মিউট্যান্ট স্ট্রেইনও ধরা পড়ল করোনার – যার নাম দেওয়া হল ‘বেঙ্গল স্ট্রেইন’। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় প্রতি দ্বিতীয় ব্যক্তি করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। বিজেপি অবশ্য ঘোষণা করেছে, বাংলার নির্বাচনে জিতলে তারা বিনামূল্যে টিকা দেবে। আর যদি না জেতে? “অযথা অভিযোগ করবেন না।”

করোনা আবহে হরিদ্বার কুম্ভ মেলা
ছবি সৌঃ news18.com

যাই হোক, টিকার কী হল? নিশ্চয়ই আমাদের সুরক্ষা প্রদান করতে সক্ষম হবে এই টিকা? ভারত টিকা উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র না? এমনকি, এই টিকা উৎপাদনের জন্য ভারত সরকার দুই সংস্থার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল – সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (এসআইআই) এবং ভারত বায়োটেক। বিশ্বের দুটি সবচেয়ে দামি টিকা দুনিয়ার দরিদ্রতম মানুষকে উপলব্ধ করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই দুই সংস্থাকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে রাজ্য সরকারের তুলনায় একটু চড়া দামে টিকা বিক্রি করার কথা জানিয়েছে এই সংস্থা দুটি। প্রাথমিক গণনা বলছে, এই টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থাদুটি বিশাল লাভের মুখ দেখতে চলেছে।

মোদীর অধীনে, ভারতের অর্থনীতির ভাড়াঁর শূন্য হয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা ইতিমধ্যেই অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিলেন, তাদেরকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। জীবনধারণের জন্য তাদের জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইনের (নারেগা) ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। এই নারেগা আইন চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে, কংগ্রেস আমলে। এর থেকে আয়ের পরিমাণও যৎসামান্য। অনাহারে দিন কাটানো গ্রামের মানুষ যে মাসিক আয়ের সিংহভাগ টিকাকরণের লক্ষ্যে খরচ করবে, এমনটা ভাবা হাস্যকর। যুক্তরাজ্যে টিকা বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। এবং সেটি মৌলিক অধিকারের আওতায় পড়ে। যারা নিজেদের পালা আসার আগেই টিকা নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, ভারতে টিকাকরণের এই বৃহৎ কর্মকাণ্ড যেন কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফার লক্ষ্যেই শুরু করা হয়েছে।

এই বিরাট বিপর্যয় যখন আমাদের চোখের সামনে সংগঠিত হচ্ছে, তখন খেয়াল করে দেখুন মোদী-জীবী টিভি চ্যানেলগুলি কেমন এক সুরে কথা বলছে। তারা বারবার দাবি করছে ‘সিস্টেম’ ধসে পড়েছে। এই ভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আসলে, ‘সিস্টেম’ ভেঙে পড়েনি। এই সিস্টেম আদৌ বিদ্যমান ছিল না। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর যাও বা অস্তিত্ব ছিল, এই সরকার, এবং পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলে তা ইচ্ছাকৃতভাবে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে দেশে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো সোনার পাথরবাটিতুল্য, সেই দেশে অতিমারীর মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব? দেশের জিডিপির মাত্র ১.২৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে খরচ করে ভারত। বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রের তুলনায়, এমনকি দরিদ্র দেশগুলির তুলনাতেও এই সংখ্যা নগন্য। অনেকের মতে এই পরিসংখ্যানও বাড়িয়ে বলছে সরকার, কারণ স্বাস্থ্য খাতে এমন অনেক খরচ যোগ করা হয়, যার সাথে মূল চিকিৎসা পরিষেবার দূরদূরান্ত পর্যন্ত সম্পর্ক থাকে না। আসল সংখ্যাটি বোধ করি ০.৩৪ শতাংশ। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হল, ভারতের মত এমন দরিদ্র দেশে, শহরাঞ্চলে ৭৮ শতাংশ স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করে বেসরকারি হাসপাতাল। গ্রামীণ এলাকায় এই সংখ্যাটি ৭১ শতাংশ। ২০১৬ সালে ল্যানসেট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে এই হৃদয়বিদারক তথ্য সামনে আসে। সরকারের অধীনে যে সম্পদগুলি এখনও রয়ে গেছে তাও প্রশাসক, চিকিৎসক, রেফারাল ব্যবস্থা এবং বীমা সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রের কারণে বেসরকারি খাতেই বকলমে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা একটি মৌলিক অধিকার। হতদরিদ্র মানুষ, যাদের চিকিৎসার খরচের যোগান দেওয়ার মত অর্থ নেই, তাদের পরিষেবা প্রদান করবে না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ তাই একটি অমার্জনীয় অপরাধ। তাই, ‘সিস্টেম’ ভেঙে পড়েনি। সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ‘ব্যর্থ’ শব্দটা বোধ হয় এই ষ্টেটে খাটে না কারণ আমাদের চোখের সামনে যা ঘটছে তা শুধুমাত্র ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স নয়। এটা মানবতার বিরুদ্ধে ঘোরতর অপরাধ। ভাইরোলজিস্টরা আমাদের সতর্ক করেছিলেন যে ভারতে দৈনিক করোনা সংক্রমণ ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আসন্ন ভবিষ্যতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর পূর্বাভাস তারা দিয়েছিলেন। আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছি, রোজ একে অপরকে ফোন করে নিজেদের বেঁচে থাকার প্রমাণ দেব। ঠিক যেমন স্কুলে যেমন আমাদের রোল কল হত। পরিজনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুক দুকপুক করে, চোখে জল চলে আসে, জানি না তাদের সাথে আবার দেখা হবে কিনা। আমরা লিখি, দৈনিন্দিন কাজকর্ম করি, কিন্তু সেই কাজ শেষ হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। সামনে কী ভয়াবহতা এবং অপমান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা ভাবলেই ভয় করে। চরম অসম্মানের ভয়। একমুহূর্তে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

গুজরাতের এক পৌরকর্মী করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ দাহ করছেন
ছবি সৌঃ PTI

#ModiMustResign হ্যাশট্যাগটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড হয়েছিল। বেশ কিছু মিম ভাইরাল হয়েছিল যাতে দেখানো হয়েছিল মোদীর দাড়ির আড়াল থেকে উঁকি মারছে স্তূপাকৃত নর খুলি। অথবা, মৃতদেহের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন সর্বশক্তিমান মোদী। কোনোটাতে দেখা গেল শকুনরূপী মোদী ও অমিত শাহ রাশি রাশি শবের মধ্যে ভোট খুঁজছেন। কিন্তু এতো মুদ্রার এপিঠ মাত্র। মুদ্রার ওপিঠে বিরাজমান এমন এক মানুষ যে সংবেদনশীলতা বোঝে না, ভাবলেশহীন চোখে লেগে আছে যার ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। ঠিক যেমন ইতিহাসের বইয়ের বর্ণিত অত্যাচারী শাসকদের মত, যার এক কথায় উদ্বুদ্ধ হয় একদল ভক্ত। ছোঁয়াচে রোগের মতই বিপজ্জনক। উত্তর ভারত – সংখ্যার নিরিখে যারা ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করেন – ওনার নির্বাচনী বৈতরণী পার করার বৃহত্তম ভিত্তি। সেই মানুষগুলিকেই নিপীড়ন করে যেন অদ্ভুত এক তৃপ্তি হয় তাঁর। 

ফ্রেডরিক ডগলাস ঠিকই বলেছিলেন, “নিপীড়িতদের ধৈর্যই অত্যাচারীর সীমা নির্ধারণ করে।” আমরা ভারতীয়রা তো নিজেদের সহ্যের সীমা সম্পর্কে গর্ব বোধ করি। রাগ প্রশমন করতে আমরা ধ্যান করি। সাম্যের অভাবকেও আধ্যাত্মিকতার অজুহাতে ভুলে থাকি। অপমানের সাথে সহবাস করি নম্রতার সঙ্গে। 

২০০১ সালে রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ নরেন্দ্র মোদীর। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গাই ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম উজ্জ্বল করেছে। প্রায় ৫০ জন হিন্দু পুণ্যার্থীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে গুজরাটজুড়ে বেশ কিছুদিন ধরে চলে মুসলিমদের নরমেধ যজ্ঞ। প্রশাসন ও পুলিশের প্রচ্ছন্ন মদতে চলে  খুন, ধর্ষণ। পুড়িয়ে মারা হয় শতাধিক মুসলিমকে। এই হিংসা থামার কয়েকমাসের মধ্যেই নতুন করে জনমত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন মোদী /কারণ তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন দলের নির্দেশে, জনাদেশে নয়। নির্বাচনের প্রচারে তিনি নিজেকে হিন্দু হৃদয় সম্রাট হিসেবে তুলে ধরেন। অবধারিতভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তাঁর দল। ২০০২ এর পর কোনও নির্বাচনে পরাজয়ের মুখ দেখেননি মোদী।

গুজরাট দাঙ্গার বেশ কয়েকজন কাণ্ডারির বয়ান পরবর্তীকালে সাংবাদিক আশীষ খেতান ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। গর্বের সাথে এই মানুষগুলো বলেছিলেন কীভাবে তারা মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিড়ে হত্যা করেছিলেন এবং পাথর দিয়ে মাথা নিষ্পাপ শিশুদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা এক বাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে মোদী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা গেছিল। সেই টেপগুলি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এই টেপগুলি আদালতে জমা দিয়েছিলেন খেতান, সেগুলির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছিল। মোদী ক্ষমতায় থাকাকালীন খেতান বহুবার সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন। কালক্রমে বেশ কিছু খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ অপরাধীকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর লেখা ‘আন্ডারকভার: মাই জার্নি ইনটু দ্য ডার্কনেস অফ হিন্দুত্ব’ শীর্ষক বইটিতে খেতান বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট পুলিশ থেকে শুরু করে বিচারপতি, আইনজীবী, প্রসিকিউটর এমনকি বিভিন্ন তদন্ত কমিটিগুলি একযোগে প্রমাণ লোপ করেছে এবং সাক্ষীদের ভয় দেখিয়েছে। মুহুর্মুহু বিচারপতি বদল আকছার হয়েছে।

এই সব জানা সত্ত্বেও ভারতের বহু স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী, বড় বড় কর্পোরেট হাউজের সিইও, এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমরা যারা মোদীর বিরোধিতায় গলা ফাটিয়েছি, তাদের আক্রমণ করা হয়েছে, অপমান করে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। “অতীতের কথা ভুলে যান” এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলা হয়েছে আমাদের। মোদীর সমালোচনার একটাই জবাব তাদের কাছে – তাঁর অসাধারন বাচন ক্ষমতা এবং কঠোর পরিশ্রম করার দক্ষতা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবমাননা ও আক্রমণ করা যেন তাদের স্বভাবসিদ্ধ। বিরোধী দলগুলিকে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার এই প্রচেষ্টায় শাসক দলের সঙ্গী হয়ে তারা আসলে ভারতের গণতন্ত্রের ভিতকেই ধ্বংস করছেন।

আর তাই, এখন আমরা নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি। এর দায় আমাদের সকলের। সুষ্ঠূ গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি স্বাধীন, সাংবিধানিক সংস্থা আজ বশ্যতা স্বীকার করেছে। এ যেন এক অদম্য ভাইরাস।

আমাদের সরকার দেশকে বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ। উল্টে, তারাই নতুন নতুন সঙ্কট তৈরি করছেন। এর কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে এই সরকারে এক ব্যক্তিই সব সিদ্ধান্ত নেন। মূল সমস্যা হল, সেই ব্যক্তি বিপজ্জনক, এবং তিনি মেধাবী নন। এই অতিমারী একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এর মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ সংস্থা, যার সদস্য হবেন শাসক-বিরোধী উভয় শিবিরের প্রতিনিধিরা। এবং সাথে থাকবেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারকরা। এঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন অতিমারী মোকাবিলায় রণকৌশল কী হওয়া উচিত।

কিন্তু নিজের অপরাধের জন্য পদত্যাগ কি মোদী করবেন? হয়তো তাঁর এই মুহূর্তে উচিত এই ‘কঠোর পরিশ্রম’ করা থেকে নিজেকে কিছুটা সময়ের জন্য নিষ্কৃতি দেওয়া। ৫৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে তাঁর জন্য একটি বোয়িং ৭৭৭ বিমান কেনা হয়েছে। সেটিও বহুদিন ধরে অকেজো পড়ে আছে। মোদী ও তাঁর সাগরেদরা চলে যেতে পারেন। তাদের সৃষ্টি করা এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কোনও কসুর করব না আমরা। না, ভারতকে একঘরে করা যাবে না। আমাদের সাহায্য দরকার।

Image
#ModiMustResign হ্যাশট্যাগে ভাইরাল হওয়া একটি মিম
ছবি সৌঃ Remicscomics

(এই প্রতিবেদনটি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল)

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Arundhuti Roy

আরো দেখুন