বাম জমানায় কেলেঙ্কারি, সস্তায় জমি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালকে?
একটি বা দু’টি নয়, বাম জমানায় রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সস্তায় জমি পেয়েছে ছোট-মাঝারি-বড় মিলিয়ে রাজ্যের ৪৫টি প্রাইভেট হাসপাতাল। সরকারের কাছ থেকে জমি বা বিশেষ সুবিধা পেলে নয়া ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাব্লিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) আইন ২০১৭ (সাত-তিন ধারা) অনুযায়ী, ২০ শতাংশ আউটডোর ও ১০ শতাংশ ইন্ডোর রোগীকে সম্পূর্ণ নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়ার কথা। নয়া আইনে এমনই ধারা রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু যখনই সরকারের কাছ থেকে জমি বা অন্য সুবিধা পাওয়ার উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়, এখন পর্যন্ত কতজনকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছেন, উত্তরে রাজ্যের বেশ কিছু বড় কর্পোরেট হাসপাতাল জানায়, ‘সরকারের কাছ থেকে কোনও জমি বা বিশেষ সুবিধা পাইনি। ওই আইন আমাদের ক্ষেত্রে খাটেই না।’
উৎপল রায় নামে দক্ষিণ কলকাতার এক সমাজকর্মী ২০২০ সাল থেকে এই বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বিতর্কিত ইস্যুতে একের পর এক আরটিআই করে যাচ্ছেন। যেমন—রাজ্যের কতগুলি প্রাইভেট হাসপাতাল সরকারের কাছ থেকে জমি ও সুযোগ সুবিধা পেয়েছে? তারা কতজন রোগীকে আউটডোর ও ইন্ডোরে নিখরচায় চিকিৎসা দিয়েছে ইত্যাদি। উত্তরে উঠে এসেছে এইসব বিস্ফোরক তথ্য।
যেসব হাসপাতাল বলছে, তারা সরকারের কাছ থেকে জমি বা সুযোগ-সুযোগ-সুবিধা পায়নি, রাজ্য নিজেই আরটিআই-এর উত্তরে জানাচ্ছে, তারা কী পরিমাণ জমি ও সুযোগ সুবিধা পেয়েছে। ফলে তথ্য জানার অধিকার আইনের প্রশ্নোত্তরে একবারে তুলকালাম বেধেছে। ছাড়ার পাত্র নন প্রশ্নকর্তা উৎপলবাবুও। রাজ্যের কাছে জানতে চেয়েছেন, কার কথা বিশ্বাস করব, আপনাদের না বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলির? আপনারা বলছেন, পূর্বতন সরকার জমি দিয়েছে। হাসপাতালগুলি বলছে, পাইনি। যদি হাসপাতালগুলির কথা সত্যি না হয়, রোগীস্বার্থে ব্যবস্থা নিন। মমতার হস্তক্ষেপ দাবি করে চিঠিতে উৎপলবাবু বলেছেন, শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ঘুরে বুঝেছি, সরকারি সুবিধাভোগী প্রাইভেট হাসপাতালগুলিতে কিছু আউটডোর ও ইন্ডোর শয্যায় বিনামূল্যের পরিষেবার অধিকার সম্পর্কে কিছুই জানেন না রোগীরা। তাঁদের জানানোও হয় না। উৎপলবাবুর আরটিআই-এর উত্তরে রাজ্য জানিয়েছে, মেডিকা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালকে ২৩ এপ্রিল ২০০৮ সালের ৯৯ বছরের লিজে ৩.৭ একর জমি দেয় সরকার। দাম পড়ে পাঁচ কোটি ৮৮ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৯৫ টাকা। বছর বছর লিজরেন্ট এক লক্ষ ৮৫ হাজার ৮২৪ টাকা। অথচ মেডিকার প্রেসিডেন্ট (কমপ্লায়েন্স) কোমল দত্ত দশহরা আরটিআই-এর উত্তরে জানান, সরকারের কাছ কোনও জমি বাবদ সুযোগ পাইনি। তাই বিনামূল্যে পরিষেবা দিতেও বাধ্য নই।
পিয়ারলেস ১৯৯৩ সালের ১০ মে সরকারের কাছ থেকে ২৭ বিঘা জমি লিজে পায়। বছরে প্রতি বিঘার লিজরেন্ট এক হাজার টাকা এবং জমির এককালীন প্রিমিয়াম অর্থাঙ্ক ৩৫ লক্ষ টাকা। সেই পিয়ারলেসের চিফ এগজিকিউটিভ (মেডিক্যাল) ডাঃ সুদীপ্ত মিত্র আরটিআই-এর উত্তরে জানান, আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনও জমি বা সুযোগ-সুবিধা পাইনি। তাই ওই আইন আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়।
দিসান তথা পি এন মেমোরিয়াল নিউরো সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০০৫ সালে ২০ জানু্য়ারি ৯৯ বছরের লিজে ২০.৭৫ কাঠা ও ১৬.৭৯ কাঠা জমি পেয়েছে। বার্ষিক লিজ ভাড়া এক টাকা এবং ১০ বছর অন্তর অন্তর তার পরিবর্তন হবে। অথচ হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাপস মুখোপাধ্যায় আরটিআই-এর উত্তরে জানিয়েছেন, আমরা সরকারের কাছ থেকে জমিবাবদ কোনও বিশেষ সুবিধা পাইনি। তাই আইনের নির্দিষ্ট ধারা আমাদের ক্ষেত্রে খাটেই না। একই ধরনের উত্তর দিয়েছেন আরও বেশ কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল।
পূর্ব ভারতের প্রাইভেট হাসপাতালগুলির সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র সভাপতি রূপক বড়ুয়া বলেন, কে কী সুবিধায় সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছেন, কিছু বলতে পারব না। তবে আইনে লেখা আছে, জমি পেলে কিছু আউটডোর ও ইন্ডোর রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা তো অনেক কম প্যাকেজ রেটে স্বাস্থ্যসাথী ও ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ স্কিমের রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি।
সেও কম খরচে চিকিৎসাই। হাসপাতালগুলিতে সেই অধিকারের কথা লেখা থাকবে কী না, সেটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। রাজ্য আমাদের কিছু করতে বলেনি।