আন্তর্জাতিক বিভাগে ফিরে যান

‘ল্যাব-লিক থিওরি’: চীনের ল্যাব থেকেই করোনা ছড়িয়েছে- কী বলছে তথ্য?

March 9, 2023 | 5 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল করোনায়। পৃথিবী জুড়ে ৬৮ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল করোনা ভাইরাস। কীভাবে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল তা নিয়ে অনেক মত রয়েছে। তবে সবচাইতে বেশি চর্চিত মতটি হল দুর্ঘটনাবশত চীনা গবেষণাগার থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল করোনাভাইরাস। একদম শুরু থেকেই চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠছে।

কিন্তু এখান থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে কি না, তা নিয়ে বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত বিশেষজ্ঞ মহল। আমেরিকান তদন্তকারীরাও এত দিন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। ২০২১ সালের নথিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, নভেল করোনাভাইরাসের উৎস, কোথা থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে, এ নিয়ে সন্দিহান তদন্তকারীরা। কিন্তু সম্প্রতি নতুন একটি রিপোর্টে আমেরিকা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে জানা গিয়েছে। সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে আমেরিকার শক্তি মন্ত্রক জানিয়েছে, কোনও দুর্ঘটনার জেরে ভাইরাসটি চীনা গবেষণাগার থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে বহু-আলোচিত ‘ল্যাব-লিক থিওরি’ নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কীভাবে এই করোনাভাইরাসের উদ্ভব ঘটেছিল বা তা ছড়িয়ে পড়েছিল- তা আজও রয়ে গেছে এক রহস্য হিসেবেই। তৈরি হয়েছে নানা তত্ত্ব, জল্পনা—কল্পনা। কিন্তু কোনওটির পক্ষেই কোনও সংশয়াতীত প্রমাণ মেলেনি। তবে আমেরিকার নতুন ‘ল্যাব-লিক থিওরি’ নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতি ফের প্রকাশ্যে চলে এলো।

দ্বিধাবিভক্ত ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা

বিতর্কের বিষয় হলো- কোভিড সংক্রমণের সূচনা হয়েছিল কোথায়? উহান শহরের একটি বাজারে? নাকি ওই শহরেই চীন সরকার-নিয়ন্ত্রিত ল্যাবরেটরিতে? বিবিসির সংবাদদাতা জন সাডওয়ার্থ গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, ভাইরাস-বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে দু’ভাগ হয়ে গেছেন এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষের উদ্দেশ্য এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অনেকের পেশাগত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকের বন্ধুত্ব ভেঙে গেছে। ভাইরাসটি যে একটা গবেষণাগার থেকেই কোনভাবে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল- এই তত্ত্বে সম্প্রতি ‘নিম্ন’ ও ‘মাঝারি মাত্রার’ নিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি মন্ত্রক এবং ফেডারেল তদন্ত সংস্থা এফবিআই।

সাডওয়ার্থ বলছেন, চারটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বাস করে যে ভাইরাসটি সম্ভবত প্রকৃতি থেকেই এসেছিল। অন্য দুটি সংস্থা এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এসব সিদ্ধান্তের ভিত্তি হচ্ছে গোপনীয় তথ্য।

নানা ধরনের তত্ত্ব, যার কোনওটিই ধ্রুব সত্য নয়

বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক– সব পক্ষ থেকেই করোনাভাইরাসের জন্ম নিয়ে নানা সময় নানারকমের তত্ত্ব দেয়া হয়েছে। কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনের উহান শহরের একটি বাজার – যেখানে বন্যপ্রাণী এবং সামুদ্রিক খাবার বিক্রি হতো– সেখানেই কোনও প্রাণী থেকে সম্ভবত ভাইরাসটি মানুষের দেহে ঢুকে পড়েছিল।

আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে যাকে বলা যায় “প্রাকৃতিক উৎস তত্ত্ব”। এর মূল কথা হলো এই করোনাভাইরাসটি কোন কোন প্রাণীর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়েছিল। এই তত্ত্বের সমর্থকরা বলেন, সার্স-কোভ-টু (পরবর্তীকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নাম) ভাইরাসটি প্রথম দেখা দেয় বাদুড়ের দেহে, এবং তার পর তা মানুষের দেহে ঢুকে পড়ে– সম্ভবত অন্য কোনও একটি প্রাণীর মাধ্যমে, যাকে বলা হয় ‘ইন্টারমিডিয়ারি হোস্ট।’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা-সহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞানী এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় যে বাদুড় বা অন্য কোন প্রাণীর দেহে এমন কোনও ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না – যার সাথে কোভিড-১৯এর মিল আছে। তখন এই তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।

চীনা কর্তৃপক্ষ নিজেরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে বলছে যে- দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বা চীনের অন্যত্র থেকে উহানে যে হিমায়িত মাংসের চালান আসছিল, তার মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে। আরেকটি গবেষণার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল চীন সরকার। সেটি হচ্ছে উহান ইনস্টিটিউটের নেতৃস্থানীয় একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শি ঝেংলির একটি গবেষণা, যা ২০২১ সালে প্রকাশ করা হয়। ওই গবেষণায় বলা হয়, তারা ২০১৫ সালে একটি খনিতে বাসা-বাঁধা বাদুড়ের দেহে আট ধরনের করোনাভাইরাস চিহ্নিত করেছিলেন। তবে তার মতে এগুলোর চাইতে প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই থেকে আসা ভাইরাস মানুষের জন্য অধিকতর হুমকি হতে পারে। চীনের গবেষকরা আরেকটি তত্ত্বও ছড়িয়েছিল, যার পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। এর বক্তব্য – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ৫০ মাইল দূরের ফোর্ট ডেরিক নামে মার্কিন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কেন্দ্র থেকেই করোনাভাইরাস তৈরি করা এবং ছড়ানো হয়েছে।

ল্যাব-লিক তত্ত্ব

ল্যাব-লিক তত্ত্বকে এক সময় একটা প্রায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই দেখা হতো। তবে নানা সময় বিশেষজ্ঞরা এরকম সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিলেও তা জল্পনা হিসেবে সব সময়ই রয়ে গেছে। চীন ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১ সালে এক যৌথ তদন্তের পর বলেছিল, ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস কোনও ভাবে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল এমন সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কিন্তু পরে এই তদন্তের সমালোচনাও হয়েছিল এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস গেব্রেইয়েসুস একটি নতুন তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, সব তত্ত্বই এখনো উন্মুক্ত রয়েছে এবং এগুলো আরও খতিয়ে দেখা দরকার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সরকারি সংস্থাও বলেছে, করোনা ভাইরাস কোনও চীনা ল্যাবরেটরি থেকে ছড়ায়নি বরং কোন প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। তবে এই বাজারটি থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরেই উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি– যেটি বিশ্বের একটি নেতৃস্থানীয় ভাইরাস গবেষণা ল্যাবরেটরি এবং এতে করোনাভাইরাস নিয়েই গবেষণা চলছিল। তবে কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি মন্ত্রক তাদের এক বিশ্লেষণে জানায়, উহানের ল্যাবরেটরিতে সংঘটিত কোনও ঘটনার ফলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়েছিল এমন জোরালো সম্ভাবনা আছে।

ভাইরাস নিয়ে গবেষণা কতটা বিপজ্জনক

বিভিন্ন দেশে যেসব ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয়- সেখানে অতি উচ্চ মাত্রার সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। এর কারণ- এধরনের গবেষণার কাজে কোনও ত্রুটি ঘটলে তা চরম বিপদ ঘটাতে পারে। যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বলের জানান, যেসব গবেষণাগারে মার্স বা সার্স ভাইরাসের মতো বিপজ্জনক করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ হয়, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই “লেভেল থ্রি বায়োসিকিউরিটি” স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর আওতায় গবেষকরা বহু ধরনের যন্ত্রপাতি, নিরাপদ ক্যাবিনেট, সুরক্ষিত পোশাক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের আবশ্যিকভাবে স্বতন্ত্র শ্বাস নেবার যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। কর্মীদের কাপড়চোপড় ও সকল রকম বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় দূষণমুক্ত করা হয়।”

অধ্যাপক জোনাথন বলের কথায়, কোন ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সময় সব ‘স্যাম্পল’ নিরাপদ কনটেইনার বা ক্যাবিনেটে রাখা নিশ্চিত করা হয় যাতে তা বাইরে বেরুতে না পারে, বা দুর্ঘটনাবশত: কেউ তার সংস্পর্শে না আসে। “এজন্য ‘নেগেটিভ প্রেশার রুম’ নামে বিশেষ ধরনের কক্ষ ব্যবহৃত হয় – যা থেকে দুষিত বাতাস বাইরে বেরোতে পারে না।” ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের গবেষণার সময় দুর্ঘটনার কথা যে আগে কখনো শোনা যায়নি তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে চীনের বেজিং-এ একটি ল্যাবরেটরিতে অন্তত দুবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা লঙ্ঘনের কারণে ৯ জন লোক সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে একজন মারা যায়। তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরেও এরকম দুটি ঘটনার কথা রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ল্যাব-লিক তত্ত্বের পেছনে রাজনীতি?

জন সাডওয়ার্থ বলছেন, এফবিআইয়ের পরিচালক এমন এক সময় এই ‘ল্যাব লিক’ তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানালেন যা থেকে বিজ্ঞানীদের একটি অংশের সন্দেহ হচ্ছে- এর পেছনে রাজনীতি কাজ করছে কিনা। তারা বলছেন, এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে-কে নিয়োগ দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর রিপাবলিকান পার্টি এখন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা এই ল্যাব-লিক তত্ত্বের প্রতি তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করছে।

তবে এটাও ঠিক যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সময় এই তত্ত্বের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি এখন অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। এ কারণেই হয়তো কিছু বিজ্ঞানী এখন তাদের এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করতে পারছেন যে ল্যাব-লিক তত্ত্বটি হয়তো খুব তাড়াতাড়িই খারিজ করে দেয়া হয়েছিল। যেমন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যারি গস্টিন, যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একজন উপদেষ্টা, তিনি করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক উৎস থেকেই ছড়িয়েছে – এ তত্ত্বের সমর্থক। কিন্তু তিনি এটাও মনে করেন যে ল্যাব-লিক তত্ত্বটিকে একেবারেই খারিজ করে দেবার পক্ষে এখনও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই এবং এমনটা করা ভুল হবে। “জনস্বার্থের বিষয়কে উড়িয়ে দেওয়া বিজ্ঞানের উচিৎ নয়”- তিনি বলছেন, “এটা ঠিক যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু ওই ল্যাবরেটরিটির ব্যাপারে তথ্য চাওয়া কি ট্রাম্পের ভুল ছিল? না।”

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে মার্কিন কংগ্রেস হয়তো এখন নতুন নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। মার্কিন বিজ্ঞানীরা উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির সাথে গভীরভাবে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু চীনের সরকারি সংস্থাগুলোর হাতে বা গবেষণা আর্কাইভগুলোতে হয়তো এখনও এমন তথ্য রয়েছে তা কাজে লাগতে পারে।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ ভাইরাস যে চীন থেকেই এসেছিল – তা উহানের বাজার হোক বা ল্যাবই হোক- এমন যে কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে চীন সরকার। চীনের জাতীয় সংবাদমাধ্যম এ ধরনের আভাসকে চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চেষ্টা বলে অভিহিত করে থাকে। মনে হচ্ছে, কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস-রহস্য ঘিরে হয়তো আগামী দিনগুলোতে ওয়াশিংটন ও বেজিং-এর মধ্যেকার তিক্ততা, শত্রুতা আরও বাড়তে পারে। যার প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#covid-19, #china, #Wuhan Lab Leak

আরো দেখুন