কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

ট্যাংরা হত্যাকাণ্ড: ঋণের বোঝায় বাড়ির তিনজন মেয়েই কেন শিকার? কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ

February 21, 2025 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ট্যাংরার শীল লেনের ব্যবসায়ী পরিবারে রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে খুনি কে? তদন্তে পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ যা মিলেছে তাতে পুলিশের অনুমান খুনি একজনই। প্রসূন দে-কেই খুনি মনে করা হচ্ছে, সঙ্গে তার ভাইও ছিলেন। বাড়িতেই দুই গৃহবধূ ও এক নাবালিকাকে খুন করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, বড়বউ সুদেষ্ণা দে ও ছোটবউ রোমি দে-কে দুই হাতের শিরা ও গলা কেটে খুন করা হয়েছে। রোমির মেয়ে প্রিয়ংবদার মৃত্যুর কারণ বিষক্রিয়া। ১৪ বছরের ওই কিশোরীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলেও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। শরীরের পাঁচ জায়গায় আঘাত রয়েছে তার। মৃত্যুর সময় মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যার ৬টার মধ্যেই।

বাড়ির তিনতলার শৌচালয় থেকে উদ্ধার হয়েছে দে পরিবারের ছোটছেলের রক্তমাখা জামা। সেখান থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে সম্ভাব্য খুনের অস্ত্র পেপার নাইফ। তা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। প্রসূনের সঙ্গে মিললেই নিশ্চিত হবে লালবাজার। কলকাতা পুলিসের ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) রূপেশ কুমার বলেন, ‘সবদিক খোলা রেখেই তদন্ত চলছে।’

বুধবার ভোররাতে রুবি মোড়ের কাছে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে। তার সূত্র ধরে একই পরিবারের দুই বধূ ও এক নাবালিকার নিথর দেহ উদ্ধার হয়। প্রাথমিক নমুনা সংগ্রহের পর তিনটি দেহ এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। দুই পরিবারের সম্মতিতে দুপুর ১২টা নাগাদ শুরু হয় ময়নাতদন্ত। পুলিস সূত্রে খবর, মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি হয়। ক্যামেরাবন্দি হয় গোটা প্রক্রিয়া। ৪ ঘণ্টা ধরে চলে ময়নাতদন্ত।

বুধবার ভোরে হাসপাতালে দেওয়া বয়ানে প্রসূন জানিয়েছিলেন, দে পরিবারের সবাই ঘুমের ওষুধ মেশানো পায়েস খেয়েছিল। সেই বয়ানের সঙ্গে অসঙ্গতি মিলল ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। বড়বউ সুদেষ্ণার রিপোর্ট বলছে, তাঁর পেটে ঘুমের ওষুধের কোনও প্রমাণ নেই। দু’হাতেরই কব্জির সামনের দিকে গভীর ক্ষত রয়েছে। গলায় ছুরির আঘাতের চিহ্ন। সেই আঘাত সুদেষ্ণা নিজে করেননি। তিন ক্ষতের জেরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু। বড়বউয়ের সঙ্গে ছোটবউয়ের দেহের আঘাতের বিশেষ তফাৎ নেই। তাঁরও দুই কব্জি ও গলার বাঁদিক থেকে ডানদিকে ছুরির ক্ষত রয়েছে। তার জেরেই মৃত্যু। রোমির পেটেও ঘুমের ওষুধের উল্লেখ নেই রিপোর্টে। তবে কি ঘুমন্ত অবস্থায় খুন? কেন চিৎকার করলেন না দুই বধূ? পুলিশের দাবি, প্রতিরোধের কোনওরকম প্রমাণ দোতলার ঘটনাস্থল থেকে মেলেনি।

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, অত্যন্ত কষ্টদায়ক মৃত্যু হয়েছে প্রিয়ংবদার। কিশোরীর বুক, নাক, ঠোঁট ও দুই পায়ে কালশিটে রয়েছে। মাথার পিছনে ভারী আঘাত। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। তার জেরে হাতের তালু ও পায়ের পাতা নীল হয়ে যায়। বিষক্রিয়ার জেরে পাকস্থলিতে রক্তক্ষরণও হয়েছে। পুলিশের অনুমান, সোমবার রাতে মারধর করে, মুখ চেপে ঘুমের ওষুধ মেশানো পায়েস খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে। তার মৃত্যু হয়েছে মঙ্গলবার দুপুরে।

দে বাড়ির দুই ভাই অর্থাৎ লেদার কোম্পানির মালিক প্রণয় ও প্রসূন দে-র ‘লাইফস্টাইল’ ছিল বেহিসেবি। দু’হাতে টাকা ওড়ানো, দেদার পার্টি, বেলাগাম জীবনযাপনের জেরে ব্যয়ের অংক বাড়তে থাকে। ব্যাঙ্ক ছাড়াও চড়া সুদে বেসরকারি ঋণদানকারী সংস্থা থেকে লোন নেন তাঁরা।

বাবার মৃত্যুর পরই একের পর এক সম্পত্তি বিক্রি। ব্যবসাতেও বিপুল টাকা ঢেলেছিলেন। কিন্তু ধস আটকাতে পারেননি। ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর কারণ হিসাবে হাসপাতালে এমনই বয়ান দিয়েছেন দুই ভাই। তাঁদের দাবি, বিপুল ঋণের বোঝার কারণেই এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।

তদন্তকারীরা জেনেছেন, কারখানা ছাড়াও শীল লেন এলাকায় দুটি বাড়ি ও দোকান করেছিলেন প্রসূন ও প্রণয়ের বাবা। শান্তিনিকেতনে রেশম চাষের জন্য ১০০ বিঘা জমিও কিনেছিলেন। পুরীতে ছিল বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি। বাবার ব্যবসা রমরমিয়ে চলছিল। বাবার মৃত্যুর পর রাতারাতি বিদেশে ব্যবসা বাড়াতে উদ্যোগী হন দুই ভাই। দুই ভাই ছাড়াও কোম্পনির ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন স্ত্রীরা। নিজেদের পাশাপাশি স্ত্রীদের নামেও বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে শুরু করেন দুই ভাই। সেই টাকায় কোটি কোটি টাকার চামড়া কেনেন। শুরু করেন আউটসোর্সিং। কিন্তু লাভ হয়নি। মরিয়া হয়ে কোম্পানির টার্নওভার বেশি দেখিয়ে ঋণের পরিমাণ বাড়ান তাঁরা। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার জন্য বসতবাড়িও বন্ধক রাখেন। ঠিকমতো কিস্তি জমা না পড়ায় ব্যাঙ্ক আর ঋণ দেয়নি। তখন শুরু হয় পার্সোনাল লোন নেওয়া। বেসরকারি সংস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া হয়। অটল সুর রোডে একটি বাড়ির সাতটি ফ্ল্যাট ও দোকান বিক্রি করে দেন তাঁরা। তা থেকে ৫-৬ কোটি টাকা পেয়েছিলেন বলে পাড়া-প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন। সেই টাকাও থাকেনি। কলকাতা থেকে পুরী, সব বিকিয়ে যায়। ‘লাইফস্টাইল’ বদলায়নি! প্রতি দু’বছরে গাড়ি বদলেছে দে পরিবার। বিদেশ ভ্রমণও চলেছে। বাড়ির ইন্টিরিয়র তাক লাগানোর মতো। প্রসূন পার্টি করতে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বারশিপও নিয়েছিলেন। লাইফস্টাইল ধরে রাখতে কোম্পানির নামে নেওয়া ঋণের টাকাই খরচ হয়ে যায় বলে দাবি পুলিশে। পাওনাদারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারখানার কর্মীদের বেতন অনিয়মিত। বাড়িতে ব্যাঙ্ক সহ অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোকজন এলেও গেট খুলতেন না তাঁরা। শেষ দু’দিন ৩০ জন পাওনাদার এসেছিল। এরপরই চূড়ান্ত পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু বাড়ির তিন মেয়েই কেন শিকার? উত্তর মিলছে না।

যে প্রশ্নগুলো উঠছে:

  • সুদেষ্ণা ও রোমি আত্মহত্যায় রাজি হয়নি। তাহলে কি তাঁদের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল? সেই কারণেই যখন কব্জি বা গলায় আঘাত করা হল, কোনও প্রতিরোধ করেননি কেউ? ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দুই বধূর পেটে কিছু পাওয়া গিয়েছে বলে উল্লেখ নেই।
  • দুই বধূ ও নাবালিকা, তিনজনেরই মৃত্যুর সময় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। রাত ১২টা ৫০ মিনিটে প্রণয়, প্রসূন ও নাবালক বাড়ি থেকে বের হয়। এতক্ষণ তারা কী করছিল? মাঝে তারা অ্যাপ ডেলিভারির মাধ্যমে খাবারও আনিয়েছে।
  • ১৪ বছরের এক কিশোরের সামনে তার মা, কাকিমা ও দিদিকে খুন করা হল। তাকে হাতের শিরা কেটে ফেলতে বলা হয়েছে বলেও দাবি। অথচ তার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই কেন?
  • মঙ্গলবার বাড়িতে ফুল দিতে বারণ করা হয়েছিল। পুরোহিতকে বলা হয়েছিল আসতে হবে না। তবে কি পরিকল্পিত খুন?
TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Tangra Case, #Kolkata, #police

আরো দেখুন