কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

ট্যাংরাকাণ্ডের রহস্য আরও জটিল হচ্ছে, একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন দুই ভাই

February 22, 2025 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: যত দিন যাচ্ছে, ট্যাংরাকাণ্ডের রহস্য আরও জটিল হচ্ছে। প্রণয় দে, প্রসূন দে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা একসঙ্গে শেষ বার কী খেয়েছিলেন? অনুসন্ধান করে দেখছে পুলিশ।

সূত্রের খবর, তদন্তকারীদের প্রশ্নের জবাবে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন ট্যাংরার লেদার ব্যবসায়ী প্রণয় ও প্রসূন দে। হুঁশ ফিরতেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন দুই ভাই। যদিও অফিসাররা তাঁদের কথায় ভরসা করছেন না। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁরা নিশ্চিত, প্রণয় ও প্রসূন রীতিমতো পরিকল্পনা করেই খুন করেছে নিজেদের বউ-মেয়েকে। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই দু’জনকে গ্রেপ্তার করবে পুলিস। আর তারপর জেরার মুখেই সামনে আসবে, ট্যাংরাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল!

দুই গৃহবধূ ও কিশোরীকে কে খুন করল? কেনই বা ১৪ বছরের কিশোরকে নিয়ে গাড়িতে গোটা শহর চক্কর দিচ্ছিলেন প্রণয়-প্রসূন? দে পরিবারের খুনের ঘটনায় এই দু’টি প্রশ্নকে ঘিরেই বাড়ছে রহস্য। যদিও সেই প্রশ্নের জট তদন্তকারীরা অনেকটাই খুলতে পেরেছেন বলে জানা যাচ্ছে। তদন্তে উঠে এসেছে, একদিকে ব্যবসায় ক্ষতি, অন্যদিকে পাওনাদারের চাপ— কোনওটাই সামাল দিতে পারছিলেন না দুই ভাই। বাজারে ঋণ ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। কিন্তু অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত অর্থ তখন প্রায় তলানিতে। প্রণয় পুলিসের কাছে দাবি করেছেন, পাওনদাররা বারবার ফোন করে তাগাদা দিচ্ছিল। সকলকেই ১৮ ফেব্রুয়ারি আসতে বলেন তিনি। কিন্তু ১১ তারিখ অবধি টাকা জোগাড় করে উঠতে না পারায় বুঝে যান, নির্ধারিত দিনে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যাবে না। তাই ১২ ফেব্রুয়ারি ভাই প্রসূনকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করেন আত্মহত্যার। পরদিন বিষয়টি নিয়ে স্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেন দু’জনে। কিন্তু স্ত্রীরা চিন্তিত হয়ে পড়েন, স্বামীরা না থাকলে তাঁদের কী হবে? পাওনাদাররা তো তাঁদের উপর চাপ বাড়াবে। ফলে শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, সকলে মিলেই আত্মহত্যা করবেন। মাঝে আর একবার শেষ চেষ্টা করেও টাকা জোগাড়ে ব্যর্থ হন দু’ভাই। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এরপর ১৭ তারিখ ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে দেন প্রসূন। ওইদিন এক পাওনাদার বাড়িতে এসে ফোন করলে তিনি জানান, আয়কর হানা হতে পারে। তাই দরজা-জানলা বন্ধ। পাওনাদারের ফোনটি কেটে দিয়ে নিজের মোবাইলটি ‘সুইচড অফ’ করে দিয়েছিলেন তিনি।

দে পরিবারের বড় ছেলে প্রণয়। তদন্তকারীদের কাছে নিজেদের প্ল্যানিং তিনি বিস্তারিতভাবেই তুলে ধরেছেন বলে খবর। জানিয়েছেন, ঘুমের ওষুধ অনলাইনে অর্ডার করিয়ে আনা হয়েছিল আগেই। ১৭ তারিখ রাতে পায়েসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে নিজের মেয়ে প্রিয়ংবদাকে খাওয়াতে যান প্রসূন। কিন্তু ওষুধের গন্ধ পেয়ে সে খেতে রাজি হয়নি। ওই কিশোরীকে কার্যত মারধর করে, মুখ টিপে জোর করে পায়েস খাওয়ানো হয়। এরপর সস্ত্রীক দুই ভাই ও প্রণয়ের ছেলেও পায়েস খায়। পরদিন সকালে উঠে মেয়ের মৃতদেহ দেখে আসেন প্রসূন। এরপর বাকিদের খুন করা হয়। প্রসূন তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছেন, ‘দাদার স্ত্রী ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। দাদা গিয়ে তাঁর হাতের শিরা কেটে দেন। মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছিল ছেলে। তার ঘুম ভেঙে যায়। সেই সময় ছুরি দিয়ে ছেলের হাতে আঘাত করে প্রণয়। এরপর নিজের স্ত্রী রোমির গলায় ছুরি চালায় প্রণয়। নেতিয়ে পড়া রোমির হাতের শিরাও কেটে দেওয়া হয়।’
যদিও প্রণয়ের বক্তব্য এর ঠিক উল্টো। তাঁর দাবি, ‘ঘুম ভাঙার পর আমি উপরে চলে গিয়েছিলাম। ভাই প্রথমে রোমিকে খুন করে, তারপর আমার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে খুন করেছে। আমার ছেলে চিৎকার করে ওঠায় তাকেও আঘাত করেছিল। এরপর আমার ছেলেকে নিয়ে তিনতলায় চলে আসে।’ তদন্তকারীদের কাছে প্রণয় আরও জানিয়েছেন, এরপর তাঁরা দু’ভাই মিলে প্রচুর মদ খান। রাত ১টা নাগাদ বের হন গাড়ি নিয়ে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চক্কর কাটার সময়েও মদ খাচ্ছিলেন তাঁরা।

আহত দুই ভাইয়ের দাবি, তাঁরা ছ’জন একসঙ্গে পায়েস খেয়েছিলেন। তাতে মেশানো ছিল ঘুমের ওষুধ। পুলিশ সূত্রে খবর, ঘুমের ওষুধ ছাড়াও আরও কিছু সেই পায়েসে মেশানো হয়েছিল। যা খেয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৪ বছরের কিশোরী প্রিয়ম্বদার। পুলিশের অনুমান, পায়েসে মেশানো হয়েছিল তুলসীপাতা। তবে এই সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তকারীরা। প্রণয়, প্রসূন এবং ওই পরিবারের কিশোর প্রতীপ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কিশোরীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, তার পেটে যে খাবার ছিল, তা পুরোপুরি হজম হয়নি। সেই খাবারে হলুদ এবং সাদাটে কণিকা ছিল। ওষুধের গন্ধও ছিল। পায়েসে ঘুমের ওষুধ ছাড়া আর কী মেশানো হয়েছিল, কেনই বা মেশানো হয়েছিল, পুলিশ দেখছে। প্রথম থেকেই এই ঘটনায় বড় ভূমিকা নিয়েছে পায়েস। যে পায়েস খেয়ে কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে, তা কি দুই ভাইও খেয়েছিলেন? তাঁদের শরীরে পায়েসের প্রভাব পড়ল না কেন? কিশোর প্রতীপই বা ঘুম থেকে জেগে উঠল কী ভাবে? প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের অনুমান, পায়েস খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন দুই বধূ রোমি এবং সুদেষ্ণা। সেই অবস্থায় তাঁদের হাতের শিরা এবং গলার নলি কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

গত বুধবার বাইপাসের ধারে অভিষিক্তা মোড়ে একটি মেট্রোর পিলারে ধাক্কা খায় প্রণয়দের গাড়ি। তাতে দুই ভাই এবং কিশোর ছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, ট্যাংরায় তাঁদের বাড়িতে দুই বধূ এবং কিশোরীর দেহ পড়ে আছে। দেহগুলি উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয় যে, তিন জনকেই খুন করা হয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#police, #Tangra Case, #Prasun Dey, #Pranay Dey

আরো দেখুন