আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠিতেই OBC সংরক্ষণ, এখানে BJP হিন্দুদের বঞ্চনার অভিযোগ তুলছে কোন যুক্তিতে?
সৌভিক রাজ

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১১.০০: সম্প্রতি ওবিসি তালিকার সম্প্রসারণ করেছে রাজ্য। এখন ১৪০টি সম্প্রদায় রয়েছে নয়া ওবিসি তালিকায়। নয়া তালিকার প্রেক্ষিতে বিজেপির অভিযোগ, হিন্দুদের বঞ্চনা করা হয়েছে এবং মুসলমানদের তোষণ করা হয়েছে নতুন তালিকায়। গেরুয়া দলের এহেন অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে মানদণ্ড ধরে সমীক্ষা করেছে সরকার। ধর্মকে ভিত্তি করে সংরক্ষণ হয়নি।
বছর ঘুরলেই বিধানসভা নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ছাব্বিশের নির্বাচনের আগে ওবিসি তালিকার সম্প্রসারণ তৃণমূলকে রাজনৈতিক ফায়দা দিতে পারে। অন্যদিকে, হিন্দুত্বের জিগির তুলে পাল্টা রাজনৈতিক ফসল ঘুরে তুলতে মরিয়া বিজেপিও। ফলে রাজনৈতিক তরজার সৃষ্টি হয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। নয়া তালিকার ক্ষেত্রে যাবতীয় নজর এখন আদালতের দিকে।
১০ জুন বিধানসভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (২০২৪-২৫ অর্থবর্ষ) পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করেন। ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী) তালিকা সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে তিনি সাফ জানান, ধর্মীয় পরিচয়কে সংরক্ষণের মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি, আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজ্য মন্ত্রিসভা আরও ৭৬টি সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছে। যার মধ্যে ৭৪টি সম্প্রদায় আগেই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের জেরে স্বীকৃতি হারিয়েছিল। এখন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ফের তাদের তালিকভুক্ত করা হয়েছে। সদগোপ ও নেপালি ব্রাহ্মণদের প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করেছে রাজ্য।
ওবিসি শ্রেণির অন্তর্ভুক্তির জন্য ১৪০টি সম্প্রদায়ের নাম প্রস্তাব করেছে কমিশন। যার মধ্যে ৭৯টি মুসলিম সম্প্রদায় এবং ৬১টি অমুসলিম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এতেই বিজেপির অভিযোগ, মুসলমানদের তুষ্ট করার জন্য ওবিসি নীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে রাজ্য। আদপে কলকাতা হাইকোর্ট পূর্ববর্তী ওবিসি তালিকা বাতিল করায় রাজ্য পদক্ষেপ করেছে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, কমিশনের কাছে এমন নথি রয়েছে যা প্রমাণ করে মুসলমান সম্প্রদায় দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে এবং অত্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে। বিজেপির অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে মমতা বিধানসভায় জানান, “একাংশ মিথ্যা প্রচার করার চেষ্টা করছে যে রাজ্য সরকার ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ করেছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওবিসি তালিকা ধর্মীয় ভিত্তিতে তৈরি করা হয়নি এবং করা হবেও না।”
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের মে মাসে কলকাতা হাইকোর্ট ১০৯ সম্প্রদায়ের ওবিসি স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়। তারপরই পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন নতুন করে সমীক্ষা করে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে বাম সরকারের আমলেই ওই সম্প্রদায়গুলিকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রাজ্য সরকার হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই শীর্ষ আদালতে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে নতুন তথ্যের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করেছে রাজ্য। সুপ্রিম কোর্ট নতুন তালিকা তৈরির জন্য তিন মাস সময় দিয়েছে। কমিশন আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সমীক্ষা চালিয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ১৪০টি সম্প্রদায়ের তালিকা তৈরি হয়েছে। নয়া তালিকায় ৪৯টি সম্প্রদায়কে এ শ্রেণিতে এবং ৯১টি সম্প্রদায়কে বি শ্রেণিতে স্থান দেওয়া হয়েছে।
জানা যাচ্ছে, আরও ৫০টি সম্প্রদায়ের জন্য সমীক্ষা চলছে। ৫০টির মধ্যে ৪১টি সম্প্রদায় জনসংখ্যার নিরিখে থেকে খুবই ক্ষুদ্র, সাতটি নতুন আবেদনকারী শ্রেণি এবং দুটির জন্য পুনরায় সমীক্ষার কাজ চলছে। কমিশন অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমীক্ষার কাজ সরকার বলে দাবি করা হচ্ছে। কতটা পিছিয়ে রয়েছে কোন শ্রেণি, তার উপর ভিত্তি করে সম্প্রদায়গুলিকে ওবিসি-এ এবং ওবিসি-বি-তে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। অধিক বঞ্চিত শ্রেণিগুলিকে এ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে, যা ১০ শতাংশ সংরক্ষণের অধিকারী। তুলনামূলকভাবে কম অনগ্রসররা বি শ্রেণিতে রয়েছে, সেক্ষেত্রে ৭ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় জানিয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। নিয়োগ পুনরায় চালু করার জন্য ওবিসি তালিকা সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়োগ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, বিজেপি বিরোধিতা শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রশ্নের উত্তর দিতে অনিচ্ছুক, হিন্দুরা বঞ্চিত হচ্ছে অভিযোগ তুলে বিধানসভা থেকে ওইদিন ওয়াক আউট করেছিলেন গেরুয়া শিবিরের বিধায়কেরা। ওবিসি তালিকা নির্ধারণে ব্যবহৃত যাবতীয় নথিপত্র, তথ্য এবং প্রমাণ ইতিমধ্যেই বিধানসভায় পেশ করেছে রাজ্য সরকার। মমতার দাবি, সমস্ত আইনি এবং পদ্ধতিগত নিয়ম মেনে সমীক্ষা করা হয়েছে। ধর্মের কোনও ভূমিকা নেই। ফলে বিজেপি অভিযোগ যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তা এক কথায় প্রমাণিত সত্য। কেবলমাত্র রাজনীতি করতেই কি বিরোধিতা করছে বিজেপি? তাই কি হাতিয়ার করা হচ্ছে হিন্দু বঞ্চনার অভিযোগ? আম জনতার মনে এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।