কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

ইরানে যুদ্ধের আবহে মনে পড়ছে মজিদ-জামশিদদের, একসময় যাঁরা কলকাতার ময়দানে ফুল ফুটিয়েছিলেন

June 23, 2025 | 5 min read

লিখেছেন দেবাশিস সেনগুপ্ত

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৩:২৬: বেশ কয়েকদিন ধরে ট্রেলার চলার পরে শনিবার রাত থেকে পুরোদস্তুর যুদ্ধ বেধে গেল ইরানে। এই প্রেক্ষিতে একটু চোখ রাখি কলকাতা ময়দানের ফুটবলে ইরানি প্রতিনিধিদের দিকে যারা একসময় ময়দানে ফুল ফুটিয়ে আপমর বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। এই বর্তমান পরিস্থিতিতে ভীষণভাবে মনে পড়ছে তাঁদের কথা।

১৯৭০-র আই এফএ (IFA) শীল্ডে কলকাতা ময়দান প্রথম পেয়েছিল ইরানি ছোঁয়া। ১৯৫৩-য় জন্ম নেওয়া ১৯৬৯-র তেহরান প্রভিন্স লিগের রানার্স আপ তেহরানের পাস ফুটবল ক্লাব (PAS Football Club) সে বছর এসেছিল কলকাতার আই এফএ শীল্ডে অংশ নিতে।

৩য় রাউন্ডে এরিয়ানকে ১-০ গোলে, কোয়ার্টার ফাইনালে বিএনআরকে ৫-০ গোলে ও সেমিফাইনালে মোহনবাগানকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের। সেবার ফাইনালে তাদের প্রথম একাদশে ছিলেন Keyvan Niknafas, Mohsen Houshangi, Hassan Habibi (c), Majid Halvaei, Hossein Kazerani, Homayoun Shahrokhi, Mohammad Sadeghi, Mehdi Monajati, Jahangir Nassiri, Parviz Mirza-Hassan ও Asghar Sharafi। এছাড়া দলে ছিলেন পরিবর্ত ফুটবলার Daud Ahmadzadeh ও Mohammad Ali Malkiyan। ২০০৭-এ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই ক্লাব ও তার ফুটবলারদের কি এখন ইরানে এই যুদ্ধ আবহে মনে পড়ছে কলকাতার?

অনেক জাতীয় খেলোয়াড়ে সমৃদ্ধ পাস ফুটবল ক্লাব (যারা ১৯৬৭ ও ১৯৬৮-র তেহরান লিগ জেতা ছাড়াও ১৯৬৮র এ এফ সি এশিয়ান কাপও জিতেছিল) ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭০-র ফাইনালে ৮০,০০০ দর্শকের সমর্থনপুষ্ট শান্ত মিত্রর নেতৃত্বাধীন ইস্টবেঙ্গল ইনজুরি টাইমে ২০২৩-র ১ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত পরিমল দে-র করা একমাত্র গোলে পাস ফুটবল ক্লাবকে হারিয়ে দিয়ে ১০-ম বারের জন্য জিতে নিয়েছিল আইএফএ শীল্ড।

সে ম্যাচে যখন আর কয়েক মুহূর্ত বাকি, তখন‌ও ফল গোলশূন্য। শক্তিশালী পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে তুল্যমূল্য লড়েছিল লাল হলুদ জার্সিধারীরা। কোচ মহম্মদ হোসেনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে যার নাম টিম লিস্টে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক শান্ত মিত্র, সেই পরিমল দে মাঠে নেমেছিলেন আহত মহম্মদ হাবিবের জায়গায়। ইডেনের সেই ম্যাচে পরিবর্ত ফুটবলার হিসেবে মাঠে নেমেই স্বপন সেনগুপ্তর বাড়ানো বল ধরে গোল করে এক ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক হয়েছিলেন পরিমল দে। সেদিন গোল শোধ করার সময়ই পায়নি পাস ক্লাবের ফুটবলাররা। ফাইনালে তাঁর অনবদ্য গোল ময়দানের প্রবীণ ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিতে আজও অক্ষত।সেই ঐতিহাসিক গোল মিলিয়ে দিয়েছিল গোটা ময়দানকে। সেদিন মাঠে নেমেই জয়সূচক গোল করে সমর্থকদের কাঁধে চেপে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।

১৯৭০-র শীল্ড ফাইনাল ম্যাচ প্রসঙ্গে একবার পরিমল দে বলেছিলেন, ”এত দ্রুত ঘটেছিল সব কিছু যে প্রথমটায় কয়েকটা দিন আমি উপলব্ধিই করতে পারিনি যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।” স্কিলের পূজারী পরিমল দে-র মতে “Yes it is more power and comparatively lesser skill nowadays. You won’t find a Chuni Goswami or Kajal Mukherjee today. But football was very competitive even during our time and it will always stay the same way.” এটি তিনি বলেছিলেন ২০২০ সালে একটি সাক্ষাৎকারে। সেই সাক্ষাৎকারেই তিনি তাঁর দেখা সেরা ৫ বিদেশী ফুটবলার বেছেছিলেন মজিদ, জামশেদ, চিমা, ব্যারেটো আর এমেকা-কে, যার মধ্যে প্রথম দুজনই ইরানি ফুটবলার।

এবার কলকাতার ক্লাবের হয়ে খেলা ইরানি ফুটবলারদের কথায় আসি। ১৯৮০ সালের কথা। কলকাতা তখন একনিষ্ঠ ও একতরফা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল শুধুই ফুটবলের সঙ্গে। ফুটবলের মরশুমে সকাল পেরিয়ে দুপুর হওয়ার আগেই তখন ময়দানে ঘেরা মাঠগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। কলকাতার তারকা ফুটবলারদের জনতা তখন তাদের ভালবাসা দিয়ে ঘিরে রাখত। অন্যদিকে কোন ম্যাচে তথাকথিত ছোট ক্লাবের কাছে তিন প্রধানের কেউ হারলে বা ড্র করলেও তখন তুমুল ঝামেলা অনিবার্য ছিল ময়দানে। এই আবহে ১৯৮০তে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মজিদের মতো ইরান থেকে একজন সদ্য বিশ্বকাপার মজিদ বাসকার খেলতে এসেছিলেন কলকাতায়, সঙ্গে জামশেদ নাসিরিকে নিয়ে। এই আসার অনুঘটক ছিলেন ১৯৭৯-এ মহমেডান স্পোর্টিংয়ে খেলতে আসা মেহমুদ খাবাজি

১৯৮০-র ১৫ই মার্চ দলবদলে আচমকাই প্রায় তারকাহীন হয়ে যাওয়া লাল-হলুদকে একক স্কিলে প্রাসঙ্গিক করে রাখা, ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে ইরানের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলা মজিদ বাসকার আজও কলকাতা ফুটবলে এক নষ্টালজিয়ার নাম। ১৯৮০-র ফেডারেশন কাপে মজিদের খেলা দেখে ইস্টবেঙ্গল জনতা বরণ করে নিয়েছিল মাঠের ক্যানভাসে পায়ের তুলি দিয়ে সৃষ্টিধর্মী ফুটবলের ছবি আঁকা এক শিল্পী মজিদকে। একজন অ্যাটাকিং মিড ফিল্ডার, যার খেলায় ছিল চমকপ্রদ স্কিলের ছটা আর গেম মেকার হয়ে ওঠার আশ্চর্য সব গুণের সমাহার। এটাই মজিদকে সবার চাইতে আলাদা করে দিত। মজিদের ফর্মের দিনে অবহেলায় আকর্ষণীয় ফুটবল খেলে দিত ইস্টবেঙ্গল। এই ধরনের খেলোয়াড়ের খেলা দেখার জন্যই লোকে মাঠে আসত, আসে আর আসবে সব কালে, সব সময়। ৮ বছর কলকাতায় খেলা মজিদ ১৯৮০ আর ১৯৮১, এই ২ বছর ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে পরের ৬ বছর খেলেছিলেন মহমেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে এবং জিতেছিলেন অনেক সর্বভারতীয় ট্রফি যেমন ৩ বার ফেডারেশন কাপ, ২ বার রোভার্স কাপ, ২ বার দার্জিলিং গোল্ড কাপ, ১ বার করে নাগজী ট্রফি ও বরদলুই ট্রফি। ব্যর্থ প্রেম, মাদকাসক্তি এবং খেলার বাইরের আরো অনেক আজেবাজে ব্যাপার কীভাবে কেড়ে নিয়েছিল মজিদ বাসকারের রাজমুকুট, সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।তারপর মজিদকে কলকাতা বোঝেনি এবং মজিদও বুঝতে চাননি কলকাতাকে। ২০১৯-এর ১ আগস্ট ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে পা দেওয়ার উদযাপন মজিদকে নিয়ে এসেছিল কলকাতায় এবং মজিদ বুঝেছিলেন, কলকাতা তাকে ভোলেনি। তারপর ১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মজিদ তার বর্তমান ঠিকানা ইরানের খোরামশহরের এক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিছুদিনের জন্য। যুদ্ধ শুরুর পরে নিশ্চুপ আছেন তিনি।

তার সঙ্গে আসা জামশেদ নাসিরিও ১৯৮০ আর ১৯৮১, এই ২ বছর ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে পরের ৩ বছর খেলেছিলেন মহমেডান স্পোর্টিংয়ের হয়ে। ১৯৮৫ ও ১৯৮৬তে আবার ইস্টবেঙ্গলে খেলেছিলেন তিনি। তিনিও জিতেছিলেন অনেক সর্বভারতীয় ট্রফি যেমন ৪ বার ফেডারেশন কাপ, ২ বার রোভার্স কাপ, ৩ বার দার্জিলিং গোল্ড কাপ, ২ বার নাগজী ট্রফি ও ১ বার করে কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড ও বরদলুই ট্রফি। তিনি অবশ্য ইরানে না ফিরে গিয়ে বরাবরের জন্য কলকাতাতেই থেকে গেছেন। তাঁর কোচিংয়ে বেঙ্গল মুম্বাই ১৯৯৮-,এ মুম্বাই সুপার ডিভিসন লিগ ও রোভার্স কাপ জিতেছিল। যুদ্ধ শুরুর পরে নিশ্চুপ আছেন তিনিও।

তাঁর ছেলে ২৫ বছরের কিয়ান নাসিরি এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একজন ভারতীয় ফুটবলার, ২০২১-২২-এর আইএসএল (ISL) কলকাতা ডার্বিতে মোহনবাগানের হয়ে যার হ্যাটট্রিক আছে। কিয়ান নাসিরি মোহনবাগানের হয়ে ২০২২-২৩ এর আইএসএল কাপ উইনার্স ও ২০২৩-২৪ এ আইএসএল শিল্ড উইনার্স। ২০২৪-২৫ এ চেন্নাইয়ান এফসি-তে খেলে এসে এবার আবার তাঁর মোহনবাগানের হয়ে খেলার খবর হাওয়ায় ভাসছে।

জামসেদ নাসিরি এবং তাঁর পুত্র কিয়ান নাসিরি

সাধারণ মানের ফুটবলার মেহমুদ খাবাজি অবশ্য কলকাতা ফুটবলে সেরকম দাগ কাটতে পারেননি।এখন তিনি পুরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ হয়ে গিয়েছেন। মহমেডান স্পোর্টিং (১৯৭৯, ১৯৮২-১৯৮৭) আর ইস্টবেঙ্গলের (১৯৮০-১৯৮১) জার্সি পরে কলকাতা ময়দানে খেলেছেন একসময়ে। ইরানের পরিস্থিতি দেখে তিনি এখন আতঙ্কিত। প্রায় ৪৮ বছর হয়ে গেছে, তিনি ইরান ছাড়া এবং সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তার পরিবারের কোনও সদস্যই আর ইরানে নেই। অনেকে কানাডায় চলে গিয়েছে। মজিদের সঙ্গে এখন কদাচিৎ কথা হয় খাবাজির। কমে এসেছে যোগাযোগ। সাদা-কালো ব্রিগেডের তিনিই প্রথম ইরানি ফুটবলার। খাবাজির হাত ধরেই সাদা-কালো শিবিরে এসেছিলেন আর এক ইরানি ফুটবলার আহমেদ সানজারি। ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরার আগে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছিলেন খাবাজি। তিনি এখন সিমেন্টের ব্যবসা করেন। ভারতের নানান অংশ তাঁর পরিচিত। তিনি ভুলতে পারেননি কলকাতাকে। তিনি বিশ্বাস করেন যে ‘আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপ্টেন হিসেবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নিশ্চয়ই তার কথা লেখা রয়েছে। তার মতে এই যুদ্ধ হয়ত এড়ানো যেত।

কলকাতা ময়দানের ফুটবলে ইরানি ফুটবলারেরা হয়ত স্বপ্ন দেখেন যুদ্ধশেষে একদিন শান্তি ফিরবে দেশে। ইরানের সকাল দুপুর যে এখন রাতের চেয়েও অন্ধকার। এই যুদ্ধ আবহে কলকাতায় খেলে যাওয়া ইরানি ফুটবলারদের কথা কি আজ ভাবেন কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরা?

(বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Kolkata, #East Bengal, #Mohammedan Sporting, #Iran vs Israel conflict, #Former Iranian footballers

আরো দেখুন