সার্নের গবেষণা যন্ত্র তৈরিতে যুক্ত ছিলেন বাংলার লেদ মিস্ত্রি, শ্রম দিবসে সংর্বধনা
না ছিল ডিগ্রি, না ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুঁথিগত বিদ্যা। পড়াশোনা বলতে চতুর্থ শ্রেণি পাশ। পেটের টানে ছোট বয়সেই ধরেছিলেন লেদ মেশিনের হাতল। হয়ে উঠেছিলেন পাকাপোক্ত মিস্ত্রি। বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস জানার গবেষণায় এই মিস্ত্রির অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বের বৃহৎ গবেষণাগার হিসেবে চিহ্নিত সার্নের (সিইআরএন) লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের এক বিশেষ অংশে হাতের ছোঁয়া রয়েছে সেই মিস্ত্রি কালীপদ পরামাণিকের। এই কাজে তাঁর সঙ্গেই উচ্চারিত হয় বিফল রায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের নাম। যে কাজের দায়িত্ব পেয়েও পিছিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া, সেই কাজই তাঁরা করে দেখিয়েছেন ভারতের ‘শেফিল্ড’ কদমতলা, দাশনগরের কারখানায়। অসাধ্য সাধন করেছেন এই জীবন্ত ‘বিশ্বকর্মা’রা।
তাঁদের হাতে তৈরি সূক্ষ্ম কাজ নজর কেড়েছিল তাবড় বিজ্ঞানীদের। সেই কাজের স্বীকৃতি না মিললেও, তাঁদের ছোঁয়া থেকে গিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ গবেষণা যন্ত্রে। বছর চুয়াত্তরের কালীপদবাবুর আক্ষেপ একটাই, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও সংসারের অনটন মেটাতে পারিনি কোনওদিন। তিনি নিজে যেমন হাইস্কুলে যেতে পারেননি কোনওদিন, তেমনই আর্থিক সঙ্কটের কারণে তাঁর চার মেয়েও মাধ্যমিকের গণ্ডির ওপারে নিয়ে যেতে পারেননি। শত দুঃখেও মেয়েদের এই ত্যাগকে আজ তিনি উৎসর্গ করতে চান বিজ্ঞানের জন্য। কালীপদবাবু হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা (বর্তমানে থাকেন হুগলির গরলগাছায়)। বিজ্ঞান আজও তাঁকে আকৃষ্ট করে। কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিক হয়েও এভাবে ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। যা তাঁর মনের খিদে মেটালেও দু’বেলা ভাত জোটাতে পারেনি। স্বীকৃতি দেয়নি কেউই।
সার্নের গবেষণাগারে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের একটি বিশেষ অংশে লাগানো রয়েছে কালীপদবাবু, বিফল রায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের হাতে তৈরি যন্ত্রাংশ। বিশ্বের সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনের জটিল পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই সার্ন। তার একটি অংশে ‘এ লার্জ আয়ন কোলাইড এক্সপেরিমেন্ট’ বা এলিস হওয়ার কথা ছিল। তারই একটি যন্ত্রাংশ তৈরির দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া সেই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। তখন এই কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব বর্তায় ভারতের সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের (এসআইএনপি) উপর। এর জন্য সেখানকার বিজ্ঞানীরা যোগাযোগ করেছিলেন হাওড়ার বিভিন্ন লেদ কারখানার সঙ্গে। এই কাজে এগিয়ে আসেন এক কারখানার মালিক। তিনি নিজের প্রায় সমস্ত সম্পত্তিকে বেচে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই কাজে। তাঁর হাত ধরেই বরাত যায় আরেকটি ছোট এক কোম্পানির কাছে। সেখানেই কাজ করতেন কালীপদবাবু, বিফলবাবুরা। হেডমিস্ত্রি কালীপদবাবুর নেতৃত্বে শুরু হয় রাত-দিন এক করে কাজ। তখন মাত্র আড়াই হাজার টাকার মাসিক বেতনে কাজ করতেন কালীপদবাবু। এই সামান্য টাকায় কীভাবে সংসার চলত, তা তিনিই জানেন! এমনকী পরবর্তীকালে ইতিহাস তৈরি করেও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি তিনি। কর্তব্য পালনের জন্য এককালীন পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ডাল-ভাত জোগাড়ের জন্য কারখানার পাশাপাশি রাতে জরির কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। একটা সময় চিকিৎসার টাকাও জোগাড় করতে পারেননি কালীপদবাবু। হুগলির নবাবপুরের একচিলতে ঘর বৃষ্টি হলেই ভেসে যেত। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কেউ এই পরিবারের খোঁজ নেয়নি। বর্তমানে ছেলে শশাঙ্ক সংসারের হাল ধরায়, জীবন সায়াহ্নে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব এই ‘বিজ্ঞানী’। তিনি বলেন, এত বড় কাজ করলেও কেউ ফিরে তাকায়নি। আমাদের ওই কাজ কি দেশের জন্য ছিল না?
রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায় তাঁকে সংবর্ধনার উদ্যোগ নিয়েছেন। কালীপদবাবু বলেন, স্বল্প হলেও বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস জানার গবেষণায় আমার অবদান থাকায় আমি তৃপ্ত। কারখানার মালিক গৌতম ঘোষ, বিফল, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকব। আজ, রবিবার মে দিবসে মন্ত্রী অরূপ রায়ের উদ্যোগে হাওড়ার শরৎ সদনের সংবর্ধিত হবেন রক্তমাংসের এই ‘বিশ্বকর্মা’। তাঁর জীবন সংগ্রামের উপেক্ষিত কাহিনি অজানাই থেকে যাবে বিশ্ববাসীর কাছে। আর সব কিছুর আড়ালে তিনি থেকে যাবেন জীবন্ত কিংবদন্তী হয়েই।