সিপাহী বিদ্রোহে বাংলার অবদানই সরকারি নথি থেকে মুছে দিল কেন্দ্র
সিপাহী বিদ্রোহের সূত্রপাত কোথায়? যে কোনও স্কুল পড়ুয়া চোখবুজে উত্তর দেবে, বারাকপুর। সেনা শিবিরে মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহই আগুনের লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল গোটা দেশ। সেই গৌরবময় অধ্যায়ের সম্মানটুকু রাখল না মোদি সরকার। ইতিহাসের গৈরিকীকরণের তাগিদে সরকারি নথি থেকে একেবারে মুছে দেওয়া হল স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার এই অবদান। সেই কৃতিত্ব দেওয়া হল অধুনা যোগী-রাজ্যকে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পত্রিকা ‘নিউ ইন্ডিয়া সমাচার’-এর ১ মে সংখ্যার বিরুদ্ধেই উঠেছে এহেন তথ্য বিকৃতির অভিযোগ।
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ কর্মসূচি নিয়েছে কেন্দ্র। তার অংশ হিসেবেই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ‘১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভারতের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। সেখানে সিপাহী বিদ্রোহের যে ইতিহাস লেখা হয়েছে, তাতে ঠাঁই হয়নি বাংলার। এরাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে এঁটে উঠতে পারেনি বিজেপি। তাই মোদি সরকার পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক দিক থেকে লাগাতার বঞ্চিত করছে বলে অভিযোগ। এবার ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি করেও কি তারা গায়ের জ্বালা মেটাচ্ছে, উঠছে সেই প্রশ্ন।
প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি উক্তি দিয়ে—‘যে জাতি তার ইতিহাসকে সম্মান করে না বা যারা দেশের ভিতকে মজবুত করেছিল, তাদের মনে রাখে না, তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।’ সেটা দেখে রীতিমতো মজা পাচ্ছেন গবেষকরা। কারণ, প্রবন্ধের ছত্রেছত্রেই যে দেশের ইতিহাসকে মনে না রাখার মরিয়া চেষ্টা। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘১৮৫৭ সালের ৩১ মে বিপ্লবের দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
যাইহোক, বিদ্রোহ কয়েক সপ্তাহ আগে ১০ মে মিরাটের সেনানিবাস থেকে শুরু হয়েছিল।… মিরাট ও দিল্লি থেকে বিদ্রোহের খবর পাওয়া মাত্রই অন্যান্য এলাকার মানুষও এতে যোগ দেয় এবং প্রথমবারের মতো ভারতে ব্রিটিশরা এত বড় গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল।’ কোথাও বাংলার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। তাতেই অবাক গবেষকরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা ইতিহাসের অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস যেমন জানাচ্ছেন, ‘মঙ্গল পান্ডে বারাকপুর থেকে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, এই তথ্য কারও অজানা নয়। ২৯ মার্চ বারাকপুরে ব্রিটিশ সেনাকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সেই বিদ্রোহই ছড়িয়ে পড়ে মিরাট ও অন্যত্র।’
ইতিহাস বিকৃতি অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। প্রবন্ধে আরও লেখা হয়েছে, ১৯০৯ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর লেখায় এই বিপ্লবকে ভারতের প্রথম ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ হিসেবে বর্ণনা করেন। এই বিষয়ে প্রবন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি উক্তিও ব্যবহার করা হয়েছে—‘বীর সাভারকর যদি না থাকতেন, তাহলে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠত না।’ এপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আশিস দাস বলেন, ‘ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ডিসরেইলির ১৮৫৭ সালেই হাউজ অব কমনসে প্রশ্ন তোলেন, ভারতের বিপ্লব কি সিপাহী বিদ্রোহ, নাকি জাতীয় বিদ্রোহ? সেই বছরই কার্ল মার্কস ‘দ্য নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’-এ স্পষ্ট লিখেছিলেন, এটি সেনা বিদ্রোহ নয়, জাতীয় বিদ্রোহ। অর্থাৎ সাভারকর যদি না লিখতেন, তাহলে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ইতিহাস হয়ে উঠত না, এটি নিতান্ত বালখিল্য কথা।’