বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা – প্রলয়
বরুণ বিশ্বাস মারা গেছেন আজ ৯ বছর হল। মারা গেছেন না বলে খুন হয়েছেন বলা ভাল। নারীর মর্যাদা রক্ষার্থে বরুণ বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন এক আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের জন্যেই প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল তাঁকে। ৯ বছর পরেও ন্যায় পাননি তিনি। তবে, মন্দের ভাল এই যে বড় পর্দায় অন্তত ওনার প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছে।
রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ছবি ‘প্রলয়’ বরুণ বিশ্বাসের জীবন-ভিত্তিক। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক কল্পকাহিনী। গ্রামের ধর্ষণবিরোধী ক্রুসেডার বরুন বিশ্বাস পেশায় একজন শিক্ষক। বরুণ তাঁর শিরদাঁড়া বিকিয়ে দেননি। তিনি নির্ভীক এবং যে কোনও কারণে আন্দোলন করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। গ্রামবাসী তাঁকে মাস্টারদা বলে ডাকে। মনে পড়ে যায় সূর্য সেনের লড়াইয়ের কথা।
তিনি কেবল ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেন না, গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতেও নিজের দলকে নিয়ে লড়ে যান বরুণ। তিনি নিরলসভাবে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালকে চিঠি লিখে গ্রামে জর্জরিত সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেছেন। অপরাধের হার বাড়ার কারণে, তিনি রাতে একটি ভিজিল্যান্ট দল তৈরী করেন। তার বাইকের শব্দে বল পান গ্রামবাসীরা, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন।
মানুষের ভাল চাওয়ার ফলও ভুগতে হয় তাঁকে। স্থানীয় বিধায়কের পোষা গুন্ডাদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন বরুণ। প্রাণে মারার হুমকিও পান তিনি। সেগুলি উপেক্ষা করে বন্ধুদের সাথে সামাজিক কাজ চালিয়ে যান বরুণ। আর তারপরই ঘটে যায় অঘটন। ছবির প্রথমার্ধের এই গল্প সত্যের কাছাকাছি, আমাদের জানা। দ্বিতীয়ার্ধে রাজ চক্রবর্তীর গল্পের বুনুন শুরু। প্লটে প্রবেশ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
শাশ্বতর চরিত্রের নাম অনিমেষ দত্ত। তিনি একজন পুলিশ অফিসার, বিশেষ শাখায় কাজ করেন। আইনের ধার ধারেন না তিনি, ন্যায়বিচার করতে সব পন্থা অবলম্বন করতেও প্রস্তুত। চরিত্রটির বেশ কয়েকটি স্তর রয়েছে। ছবির শেষ পর্যন্ত দর্শক ধন্দে থাকবেন, তিনি খারাপ লোক না ভাল। অন্যদিকে, পরানের বরুনের সহকর্মী বিনোদ বিহারী দত্তর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বরুন হত্যার ন্যায়বিচার তার মূল লক্ষ্য। বরুনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর জীবন গ্রামবাসীদের কল্যাণে উৎসর্গ করবেন।
খলনায়কের চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। দর্শক হিসেবে তার প্রতি একরাশ ঘৃণা জন্মাবে আপনার মনে। বরুনের চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় যেমন জীবন্ত করে তুলেছেন সুটিয়ার ক্রুসেডারকে, রুদ্রনীলও কোনও খামতি রাখেননি তার চরিত্রকে ক্রূঢ় প্রতিপন্ন করতে। দুর্গার চরিত্রে মিমিও যথাযথ।
‘প্রলয়’ ছবিটি এত বছর পরও দেখতে ভাল লাগে কারণ রাজ চক্রবর্তী সততার সাথে এই গল্পটি বলেছেন। একজন নির্ভীক লড়াকু বিপ্লবীর জীবন বিস্মৃত হওয়ার থেকে রক্ষা করেছেন তিনি। সুপ্রিয় দত্তের চিত্রগ্রহণ এবং বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য সম্পাদনা ছবিটিকে চিত্তাকর্ষক করে তোলে। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সঙ্গীতও মন ছুঁয়ে যায়।
আমরা সকলেই প্রতিনিয়ত সিস্টেমকে দুষি। কিন্তু এই সিস্টেমকে বদলানোর দায়ও কিন্তু আমাদেরই। তাই, বরুণ বিশ্বাস থেকে বিনোদ দত্ত, দুর্গা থেকে অনিমেষ দত্ত – সকলের থেকেই লড়াইটা শেখার প্রয়োজন আমাদের।