কর্নাটকে মেরুকরণের তাগিদে খ্রিস্টান, মুসলিম কাউকেই রেয়াত করছে না বিজেপি!
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হাতে গোনা কয়েকদিন পরেই কর্নাটকে বিধানসভা ভোট। সহজেই বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছে এরকমটা কোনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন না। বরং এবারের বিধানসভা ভোট কর্নাটক বিজেপি’র কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি পুরোপুরি নিজেদের ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলতে শুরু করেছে। বিজেপি নেতারা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখে মেরুকরণের পথকে আরও প্রসস্ত করছেন।
যেমন, খ্রিস্টান ধর্মালম্বিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য কর্ণাটকের বিজেপি নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী মুনিরথনার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করলেন একজন গেজেটেড অফিসার।
৩১শে মার্চ একটি বেসরকারী নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, বাসভরাজ বোম্মাই সরকারের উদ্যানপালন মন্ত্রী মুনিরথনা বলেছিলেন, ‘খ্রিস্টানরাও এই মুহূর্তে মানুষকে ধর্মান্তরিত করছে। বস্তি অঞ্চলগুলিতে এই ধরনের ধর্মান্তরণের ঘটনা বেশি ঘটছে। যেখানে ১,৪০০ জন লোক আছে, সেখানে অন্তত ৪০০ জনকে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। যদি তারা (ধর্মান্তরনের জন্য) আসে তাহলে তাদের লাথি মেরে বের করে দেবেন অথবা থানায় অভিযোগ করবেন।’
আরআর নগরের এই বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে রাজরাজেশ্বরীনগর থানায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১৭, ১৫৩এ এবং ১২৫ ধারায় মামলা করা হয়েছে।
তবে তিনি যে এই প্রথম কোনও বিতর্কে জড়িয়েছেন, এমনটা কিন্তু নয়। এর আগেও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ৩১ মার্চ, ব্যাঙ্গালোর গ্রামীণ কংগ্রেসের সাংসদ ডি কে সুরেশ পুলিশের কাছে মুনিরথনাকে গ্রেপ্তার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কারণ, কংগ্রেসের রাজরাজেশ্বরী নগরের প্রার্থী কুসুমা হনুমন্থরায়াপ্পা বিজেপি নেতাকে কন্নড়িদের এবং তামিলদের মধ্যে বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরির জন্য উস্কানি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
আবার, কিছুদিন আগে বেঙ্গালুরুতে চাহিদামতো ঘুষ দিতে না পারায় গোরক্ষক বাহিনীর হাতে খুন হতে হয়েছিল এক মুসলিম ব্যক্তিকে। সেই ঘটনার পরদিনই অভিযুক্তদের সঙ্গে বিজেপির যোগ প্রকাশ্যে এল। এই ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত পুনিত কেরেহালির সঙ্গে বিজেপি যুব মোর্চার (BJYM) সর্বভারতীয় সভাপতি তেজস্বী সূর্যর ছবি দেখা গিয়েছে। যা নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন।
কয়েকদিন আগেই রাজ্যের ওবিসি মুসলিমদের ৪ শতাংশ সংরক্ষণ বাতিল করেছে কর্নাটক সরকার। সেই সিদ্ধান্তের প্রশংসায় সরব হয়েছিলেন কর্নাটকে ভোট প্রচারে আসা অমিত শাহ। যদিও সে দিনই অন্য আর একটি সিদ্ধান্তে কর্নাটকের বিজেপি সরকার জানিয়ে দেয় মুসলিমদের বাতিল হওয়া ৪ শতাংশ সংরক্ষণের ফায়দা সমান ভাবে পাবে রাজ্যের দুই হিন্দু গোষ্ঠী লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা সম্প্রদায়। আবার, কংগ্রেস দাবি করেছে— ক্ষমতায় ফিরেই ওই সিদ্ধান্ত খারিজ করবে তাঁরা। যা দেখে অনেকেই বলছেন, দু’পক্ষই যে যার মতো নিজেদের ভোটারদের বার্তা দিতে মরিয়া।
আবার, এবারের ভোটযুদ্ধকে টিপু সুলতান বনাম সাভারকরের অনুগামীদের প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। রাজ্যের বিজেপি সভাপতি নলীন কাটিল গত মাসে সরাসরি তা জানিয়েও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, টিপুর বংশধরদের শেষ করে দিতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সাভারকরের অনুগামীদের। প্রকাশ্যে বলেছিলেন, লড়াই হবে সাভারকর বনাম টিপু সুলতানে।
সেই লড়াইয়ে উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়ার বীরত্ব চিত্রায়িত করার প্রয়োজন কোথায়? এখানেই রয়েছে রাজ্যের জাতভিত্তিক রাজনীতির ঝলক। কর্ণাটকের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক দুই হিন্দু সম্প্রদায়। লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা। রাজ্যের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ লিঙ্গায়েত, ১৪ শতাংশ ভোক্কালিগা। রাজ্য রাজনীতির ক্ষমতার শীর্ষে এই দুই সম্প্রদায়ই বরাবর আসীন থেকেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) নেতা এইচ ডি দেবেগৌড়া। তিনি ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর পুত্র এইচ ডি কুমারস্বামী রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কর্ণাটকের মহীশুর (অধুনা মাইসুরু) অঞ্চলে ভোক্কালিগা সমাজই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী।
ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের শক্তিধর দল কংগ্রেস ও জেডিএস। বিজেপি কখনো দাঁত ফোটাতে পারেনি। এ অবস্থায় ভোক্কালিগা সমাজের মন জিততে উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়ার মতো দুই ‘কাল্পনিক’ চরিত্রের জয়গান গাইতে বিজেপি উঠেপড়ে লেগেছে। তারা মনে করছে, এ সিনেমা তৈরির উদ্যোগ দুটি পাখি একসঙ্গে মারতে পারবে। ভোক্কালিগা সমাজের সমর্থন পাবে বিজেপি এবং টিপু সুলতানের অনুগামীদের পেছনে ফেলে সাভারকরের অনুগামীরা ক্ষমতাসীন হবেন।
অর্থাৎ বিজেপি কর্ণাটকে ভোট বৈতরণী পার হতে সব ধরনের মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে বিদ্বেমূলকমূলক ভাষণের ফুলঝুরি!