নারীর ক্ষমতায়ন ও মহাশ্বেতার কলম
শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, সমাজতত্ত্বেরও জায়গা রয়েছে মহাশ্বেতাদেবীর রচনায়। তিনি প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করেছেন এবং সেই উপলব্ধ অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। আদিবাসী জনজাতিদের সঙ্গে থেকে তাদের জন্যে সংগ্রাম করে তাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন।
মহাশ্বেতা দেবী, তাঁর লেখায় নারী চরিত্রদের বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন। । চরিত্র-নির্মাণে মহাশ্বেতা দেবীর কোন তুলনা হয় না। আদিবাসী জনজাতির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সমস্যা তাঁর প্রতিবাদী কলমে বারবার উঠে এসেছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের গোহালদেহী নামের ছোট গ্রামের মেয়ে চুনী কোটালের কথা অনেকেই জানি, লোধা সম্প্রদায়ের সেই নারীকে কীভাবে বারবার বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ১৯৮৫ সালে তার সম্প্রদায়ের তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। সকল রকম মানদণ্ড পূরণ করা সত্ত্বেও তাকে পাস গ্রেড দিতে অস্বীকার করে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। বলা হয় শিক্ষাগ্রহণের কোনও অধিকার তার নেই। ছোট থেকে বার বার নিপীড়নের শিকার হতে হয়। সম-সম্প্রদায়েরই একজন মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেন তিনি, কিন্তু একসঙ্গে থাকা হয়নি। শেষমেশ অপমানিত ও হতাশ চুনী ১৯৯২ সালে আত্মহত্যা করেন । তাঁকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী ‘ব্যাধখণ্ড’ লিখে সামাজকে বার্তা দেন।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখেন ‘রুদালী’, রাজস্থানের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নারীকে নিয়ে, অর্থের বিনিময়ে মৃতের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে যারা। এই ‘রুদালী’ গল্পের নায়িকা শনিচরী, কলেরায় স্বামীর মারা গেলেও, স্বামীর জন্যে তার কাঁদা হয়নি, শাশুড়ির মৃত্যুর পরেও সে কাঁদেনি। কিন্তু তাঁকে অর্থ রোজগারের জন্যে এবাড়ি-সেবাড়িতে গিয়ে মাথা চাপড়ে চাপড়ে কাঁদতে হয়েছে। কান্নার রকমফেরে মজুরি ধার্য হয়েছে!
পর পর লেখেন দ্রৌপদী, শিকার, বায়েন। সমস্ত সম্প্রদায়ের নিপীড়িত মেয়েদের ভাষা হয়ে ওঠেন মহাশ্বেতা।
১৯৭০ সালের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখেন উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’। সুজাতা নাম্নী নামে এক মায়ের গল্প, যাঁর পুত্র ব্রতীকে তার আদর্শের জন্যে রাষ্ট্র পাশবিকভাবে হত্যা করেছিল। লাশকাটা ঘরে ব্রতীর নম্বর ছিল ১০৮৪। সমগ্র উপন্যাসে কঠোর মানসিকতার নারী হিসেবে চিহ্নিত সুজাতা যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গিয়েছেন।
সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সারা। জীবন ধরে তা নিশ্চিত করতেই কাজ করে গিয়েছেন মহাশ্বেতা।