বুদ্ধিজীবীর খোলা চিঠি অগ্নিমিত্রার অশালীন মন্তব্যের বিরুদ্ধে
কদিন আগেই বিজেপির (BJP) মহিলা নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল (Agnimitra Paul) তমলুকের সভায় কুৎসিত এক মন্তব্য করেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) বিষয়ে বলেন, ‘দিদিমণি বলে দিয়েছেন, শরীর গরম হলেই ধর্ষণ কর। চাকরি দিতে পারিনি, তাই মনোরঞ্জনের জন্য ধর্ষণ কর। বলে দিয়েছেন, তোরা ধর্ষণ কর, আমি ক্ষতিপূরণ দেব।’
অগ্নিমিত্রার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার বলেছেন, ‘যারা এই ধরনের মন্তব্য করছেন, তাঁদের এতদিন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবেই জানতাম। হঠাৎ তাঁরা এই ধরনের কাজকর্ম করছেন দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই ধরনের সমস্যা বাংলার একার নয়। এটা সারা ভারতের সমস্যা। আজ যে অভিযোগ তিনি ‘দিদির’ হাতে তুলে দিচ্ছেন, সেই অভিযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেও বর্তায়।’
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির বক্তব্য, ‘ওঁর সম্পর্কে আমার অন্য শ্রদ্ধা ছিল। সমাজে ওঁর অন্য পরিচিতি ছিল। উনি অত্যন্ত গুণী ফ্যাশন ডিজাইনার। আমি ভাবতে পারি না উনি এই ধরনের মন্তব্য করছেন। এতে বোঝা যায়, ওঁর দর্শন এরকম। ওঁর মুখ দিয়ে যে জঘন্য শব্দরাশি বেরোচ্ছে, ওঁরা বোধহয় এভাবেই নেতা-নেত্রী হয়ে ওঠেন।’
আজ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় ফেসবুকে অগ্নিমিত্রা পালের বিষয়ে একটি খোলা চিঠি দেন। তাঁর চিঠিটি তুলে ধরা হল।
প্রিয় অগ্নিমিত্রা,
আপনি আমার পরিচিত এবং আমায় ‘রত্নাবলীদি’ বলে সম্বোধনও করেন| মাঝে মাঝে আমি আপনাকে ‘অগ্নি’ বলেও ডেকে থাকি। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনি অগ্নিমিত্রা পাল। আপনি যখন পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে কোনও মন্তব্য করেন, সেখানে অন্য সম্পর্কের গুরুত্ব থাকে না। তখন আপনি আমার ‘বন্ধু’ কিনা, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আপনি কতটা শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন, এ সব কিছুই আর ‘ম্যাটার’ করে না! সম্প্রতি আপনার মুখ থেকে ধর্ষণ সম্পর্কে এমন কিছু কথা শুনলাম যাতে বাধ্য হচ্ছি এই খোলা চিঠি লিখতে। ধর্ষণ বিষয়টা যাতে নিত্যনৈমিত্তিক, স্বাভাবিক কাজে পরিণত না হয়, তার জন্য আমরা যারা লড়ছি, তাদের কাছে আপনার এই মন্তব্য চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। আপনি যে কথাগুলো বলেছেন তাতে শুধু যে মেয়েদের প্রতি অপমান আছে তা নয়, ধর্ষণকে আরও বেশি স্বাভাবিক করে তুলতে সাহায্যই করছেন আপনি!
আপনি ঠিক কী বলেছেন, টিভি আর পত্রিকার সুবাদে তা সকলেরই জানা হয়ে গেছে এতক্ষণে। ‘শরীর গরম’ আর ‘ধর্ষণ’কে একজায়গায় মিলিয়ে দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চাইলেন অগ্নিমিত্রা? যৌনতার সঙ্গে ধর্ষণের কোনও যোগসূত্র নেই, এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল, তা কি আপনি জানেন না? ইতিহাসে ধর্ষণ বারেবারে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে। ধর্ষণ আসলে একটা ‘প্রকাণ্ড ধমক’ – শুধরে যাও, না হলে কিন্তু…! ধর্ষণের মাধ্যমে পুরুষ নারীকে বুঝিয়ে দিতে চায় কোথায় নারীর স্থান! শরীর গরম মানেই ধর্ষণ এই সহজ সমীকরণ, এই কার্যকারণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কি অত্যন্ত নিম্নমানের তর্ক নয়? শরীর গরম হলে মানুষ অন্য আরও অনেক কিছু করতে পারে, ধর্ষণ নয় | শরীর গরম হলে, ধর্ষণ করো, বিনোদনের জন্য!!!!! এই উচ্চারণের মধ্যে শুধু রয়েছে পভার্টি অফ থোট ( poverty of thought)। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ( political etiquette) বলেও তো একটা জিনিষ আছে, অগ্নিমিত্রা?
আর একটা কথা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথা বলেছেন বলে আপনার দাবি, তিনি সে কথা কবে কোথায় বলেছেন আমার জানা নেই। বরং মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে আমার যতটুকু ধারণা, তিনি নানারকম কথা বলতে পারেন, যেমন ‘হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাব’…. কিংবা প্রধানমন্ত্রী মিথ্যুক…. কিংবা…. দেখে নেবো….ভেঙ্গে দেবো, দিস্তা দিস্তা কাগজ ছুঁড়ে ফেলা, ইত্যাদি | তিনি বলতে পারেন, ‘প্রেম করার মধ্যে কোনও অসুবিধে নেই, তোমরা প্রেম করো। আমি আমার ভাইয়ের বউকে বলেছি প্রেম করো’; কিন্তু ‘শরীর গরম হলে ধর্ষণ করো’ এটা একেবারেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা নয়, তাঁর উচ্চারণ নয়। আমরা যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাবার্তা একটু হলেও শুনে থাকি, আমরা জানি এটা তাঁর প্যাটার্ন নয়।
আপনি কি বুঝতে পারছেন অগ্নিমিত্রা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন বা হারজিতের মধ্যে ধর্ষণকে নিয়ে আসা একধরনের দৈন্য? যেখানে কথা বলার জন্য আরও অনেক বিষয় আছে? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এত বাড়ছে কেন, আপনি তা নিয়ে কথা বলতে পারতেন! কৃষক দের বিপন্নতার পক্ষে সওয়াল তুলতে পারতেন! তাঁদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার আর্জি জানাতে পারতেন! আপনি কথা দিতে পারতেন প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে থাকবেন! মেয়েরা যাতে নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারেন, সে নিয়ে আশ্বাস দিতে পারতেন! অথচ এ সব কিছু আপনার কাছ থেকে আমরা পেলাম না! আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আপনার দলেরই আর এক রাজনীতিকও অম্লানবদনে বলে দিলেন ‘যা হয়েছে তাই তো বলছে, এত হইচইয়ের কী আছে!’ আমরা জানি দল হিসেবে বিজেপি সবসময় একটা সতী নারীর ছবি আঁকতে চায়! সতী নারীর কনস্ট্রাক্ট কি এটাই অগ্নিমিত্রা?
অগ্নিমিত্রা, আপনারা অন্যান্য রাজ্যে ক্ষমতায় আছেন, স্বপ্ন দেখছেন এ রাজ্যেও বিজেপিকে ক্ষমতায় আনবেন। সেখানে এ ধরনের কথা আপনাদের বিরুদ্ধে যাবে, এটা কি আপনারা জানেন না? কারণ আপনার বলা কথাগুলো আমরা মনে রাখব। ঠিক যেভাবে আমরা মনে রেখেছি কামদুনির কথা, কুশমান্ডির কথা, সুজেট জর্ডনের কথা! কামদুনিতে কী হয়েছে আমরা জানি, কুশমান্ডির মেয়েটির কী হল জানতে পারিনি, সুজেট জর্ডনকে বেশ্যা বলা হয়েছিল, বলা হয়েছিল ‘ছোট ঘটনা’ সেটাও আমরা মনে রেখেছি। একইভাবে আপনার বলা কথাগুলোও আমরা মনে রাখব।
মনে রাখছি অগ্নিমিত্রা!