বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় থেকে বাঘাযতীন 

December 8, 2020 | 4 min read

১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায় মামার বাড়িতে জন্ম নেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরত্‍শশী মাত্র ৩৬ বছর বয়সে দেশের জন্য জীবন উত্‍সর্গ করে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জীবদ্দশায় করেছেন সরকারী চাকুরি, ছিলেন বেঙ্গল গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিব। চাইলে খুব সুখেই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু দেশ মাতৃকার জন্য গভীর ভালোবাসা ছিল তার, তাই ছুটে এসেছেন দেশের তরে। সে কারণে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে ওঠেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। 

ঘোর যন্ত্রণায় যখন মানুষজন অস্থির তখন যতীনের মামাতো ভাই ফণিবাবু বাঘটিকে মারার সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনাক্রমে যতীন তখন তার মামার বাড়িতেই। সকলের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সামান্য এক ভোজালি (ছোট চাকুর মতো একধরনের অস্ত্র) নিয়ে ফণিবাবুর সাথে বাঘ মারা দেখতে গেলেন। সমগ্র গ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও বাঘটিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সবাই জঙ্গলের পাশের মাঠে বাঘ শিকারের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ফণিবাবুর বন্দুক তাক করা ছিল জঙ্গলের দিকে। বাঘ বোধহয় বন্দুকটি দেখতে পেয়েছিল, তাই বন্দুকের দিক দিয়ে বের না হয়ে যতীনের পেছন দিয়ে বের হল। বাঘ দেখামাত্রই গ্রামবাসী স্বভাবসুলভ ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। ফণিবাবু সতর্কভাবেই বাঘের দিকে গুলি ছোঁড়েন। দুর্ভাগ্যবশত গুলিটি বাঘের মাথা ঘেঁষে চলে যায় এবং প্রতিক্রিয়ায় বাঘটি আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সর্বনিকটে অবস্থানরত যতীনকেই আক্রমণ করে বসে। যতীনও দমবার পাত্র নয়। সামান্য ভোজালি দিয়ে সেও বাঘটিকে আঘাত করতে থাকে।

উভয়ের মধ্যে মিনিট দশেক ধরে ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে। উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি শর্ত, জানে বাঁচতে হলে অপরকে হত্যা করতে হবে। তাই চলে মরণপণ যুদ্ধ। বাঘের আঁচড়ে যতীনের সমগ্র শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যতীনের পা। যতীনও ভোজালি দিয়ে ক্রমাগত বাঘের মাথায় আঘাত করতে থাকে সে এবং শেষ পর্যন্ত বাঘটিই পরাজিত হয়। প্রায় ৩০০ স্থানে জখম হয় যতীনের। মামারা তাকে সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তত্‍কালীন কলকাতার সেরা ডাক্তার সুরেশপ্রসাদ তার চিকিত্‍সার ভার গ্রহণ করলেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয় না। ধীরে ধীরে একটু উন্নতি হলেও দুটি পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা কেটে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে মামাদের অসামান্য সেবা-যত্নের বদৌলতে এক সময় সম্পূর্ণ সুস্থ হন যতীন। আর তার বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সুরেশপ্রসাদ তার নাম দেন ‘বাঘা’ যতীন।

ছোটবেলা থেকেই খুব চঞ্চল ছিলেন। যেখানে যা পেতেন তা-ই করতেন। গ্রামের দুরন্ত ছেলের সকল বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল তার মধ্যে। মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকবার। মামাদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন দিগ্বিদিক। দায়িত্বজ্ঞানের দিক থেকেও বেশ সচেতন ছিলেন তিনি। তাই সবসময় মামাদের ওপর নির্ভর করতে চাননি। চেষ্টা করেছেন আত্মনির্ভরশীল হবার। এই তাগিদেই শিখেছেন শর্টহ্যান্ড নেয়া ও টাইপরাইটিং।

হঠাত্‍ স্বাস্থ্য খারাপ হলে মামা ললিতকুমার তাকে ভর্তি করেন অম্বুগুহের কুস্তি আখড়ায়। আর এই কুস্তির আখড়া যতীনের জীবন বদলে দিয়েছিল। কেননা সেখানেই যতীনের সাথে পরিচয় হয়েছিল বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের। সেখান থেকেই দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যতীন। পরবর্তীতে নানা ধরনের সেবামূলক কাজের সাথে নিয়োজিত হয়েছিলেন তিনি। কলকাতায় কাজ করবার সময়ও তার এই সেবামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল।

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ( Jatindranath Mukherjee )

অন্যায় দেখলে মাথা চড়ে যেত যতীনের। সেকারণে বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ সৈনিক পেটানোর মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি। মাঝে মাঝে তিন-চার জন সৈনিককে একাই পিটিয়েছেন। এবং সেসব কথা ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কান অবধি পৌঁছেছে সন্দেহাতীতভাবেই।

৭০০ টাকা বেতনের চাকুরি ছেড়ে ১৯০২ সালে কলকাতা আসেন আরেক বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। তত্‍কালীন ৭০০ টাকা মানে বর্তমান লক্ষ টাকারও বেশি। যে লক্ষ টাকার চাকুরি ছেড়ে দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে তার ওপর ভরসা করা যায় নিশ্চিন্তে। যতীন ভুল করেননি, ভরসা করেছেন অরবিন্দ ঘোষের ওপর। শিখেছেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালানোর কৌশল। বিপ্লবী দলের লোকজন মিলে এক বছরের মধ্যেই কলকাতার ১০২ নং আপার সার্কুলার রোডে গড়ে তুলেন বিপ্লবী আখড়া।

প্রায় পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। সময়ের পরিক্রমায় যতীন হয়ে ওঠেন সেখানকার প্রধান। কর্মসূত্রে তিনি বাংলার গভর্নরের ব্যক্তিগত নির্বাহী। তবে খুব বেশিদিন চলতে পারেনি সেভাবে। ১৯০৮ সালে যতীনদের বোমা তৈরির কারখানা জব্দ করে পুলিশ। জানতে পারে বিপ্লবী দলে রয়েছে সরকারের ব্যক্তিগত একজন সচিব।

এসব দেখে ঘাবড়ে যাননি যতীন। কাজ চালিয়েছেন সদর্পে। সে সময়ে সমগ্র বাংলা অঞ্চলে বেড়ে যায় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড। সামাল দিতে সরকার বিশেষ এক ক্ষমতা প্রদান করে ম্যাজিস্ট্রেট সামসুল আলমকে। সে ক্ষমতা ব্যবহার করে যে কাউকে গ্রেফতার করার বিধান ছিল। ক্ষমতার যথেষ্ট ব্যবহারও করতে লাগলেন তিনি। ফলস্বরূপ বিপ্লবীদের হাতে অকালেই মারা পড়তে হলো তাকে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন যতীন। ঐতিহাসিক হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় যতীনকে। প্রলোভনের পাশাপাশি চলে তুমুল অত্যাচার। তবে মুখ খুলেননি যতীন। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে গ্রেফতারের এক বছর পর ছেড়ে দিতে হয় যতীনকে। তখন ১৯১১ সাল চলছে।

১৯১৩ সালের বন্যা সুযোগ তৈরি করে দেয় বিপ্লবের। বন্যার্তদের সাহায্য করবার জন্য সমগ্র ভারতের বিপ্লবীদের আমন্ত্রণ জানান। সাহায্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে বিপ্লবের পরিকল্পনা। ভারতের সকল সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সম্মতিক্রমে তাদের সর্বাধিনায়ক হন যতীন।

বন্যার এক বছর পর ১৯১৪ সালের অগাস্টে জার্মানদের সাথে যুদ্ধ বাধে ব্রিটিশদের। ব্যস্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন সর্বাধিনায়ক। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সশস্ত্র বিপ্লবের চেষ্টা চালানো হয়। সাথে যোগ দেয় আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত গদার পার্টি। যতীনের মাথায় তখন সমগ্র ভারত স্বাধীন করবার চিন্তা। রাসবিহারী বসু এবং শচীন্দ্রনাথের সহায়তায় ভারতের বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাবে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং একটি অভ্যুত্থানের জন্য সকলকে প্রস্তুত করে তোলেন।

১৯১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের লাহোরে হামলার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সকল পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয় রামশরণ দাস নামক এক অবাঙালির বাড়িতে। হামলার চার দিন পূর্বে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তিনি। সব কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দ্রুত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। লাহোরের চারটি স্থান থেকে হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি এর একটিতে হামলা করে ব্রিটিশ সরকার। প্রতিউত্তর দিতেও বেশি দেরি করেনি বিপ্লবীরা। হামলা করে জালিয়ে দেয় লাহোরে ব্রিটিশ সেনানিবাস। আহত হয় উভয় পক্ষের অনেকে। সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশ সরকার। আর ঐ অবাঙালির বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্যর্থ হয় একটি নিশ্চিত বিপ্লব। পরবর্তীতে আবারও নতুন পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী বুড়িবালাম নদীর তীরে চার সহযোগী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য জার্মান অস্ত্র ব্যবহার করে বালেশ্বর রেললাইন দখল করে ব্রিটিশ সৈন্যদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ভ্রমণ বন্ধ করা। কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে ততক্ষণে যতীনকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কারের ঘোষণা পৌঁছে গেছে।

১৯১৫ সালের নয় সেপ্টেম্বর গ্রামবাসীর সহায়তায় বিপ্লবীদের আটক করে ফেলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তবে লড়াই বিনা প্রাণ দেননি কেউ। সম্মুখ যুদ্ধে সেদিনই মারা যান চার সহযোদ্ধার এক জন। বিপ্লবী যতীন গুরুতর আহত অবস্থায় বালেশ্বর হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরদিন সকালে মৃত্যুবরণ করেন। সমাপ্তি হয় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আরো একটি জোরালো প্রচেষ্টা। স্বাধীনতা পিছিয়ে যায় আরো বেশ কিছু বছর।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Bagha Jatin, #Jatindranath Mukherjee

আরো দেখুন