বাংলাব্যাপী ১০টি প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এবং বিখ্যাত শিব মন্দিরের ইতিহাস খুঁজলো দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলার হাজারও পালাপার্বনের মধ্যে অন্যতম হল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ শিবরাত্রি।

March 1, 2022 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi

বাংলার হাজারও পালাপার্বনের মধ্যে অন্যতম হল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ শিবরাত্রি। লোকায়ত দর্শন এবং শাস্ত্রীয় দর্শন; দুটিতেই এই উৎসব সম্মানীয় স্থান পেয়েছে। যার কারণ হলেন শিব, বাংলা স্মরণাতীত কাল থেকেই শিবের উপাসনা করে আসছে। রাজ্য জুড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র মিলিয়ে অসংখ্য শিব মন্দির রয়েছে।

উত্তর থেকেই শুরু করা যাক-

১) জল্পেশ মন্দির

জলপাইগুড়ি জেলার জল্পেশ মন্দির হল উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান শৈব তীর্থ। ভ্রামরী শক্তিপিঠের ভৈরব হলেন জল্পেশ। এখানে শিব গর্তের মধ্যে বিরাজ করেন, তাই তিনি অনাদি নামেও পরিচিত। মন্দির চত্বরে রয়েছে ‘সুবর্ণ কুণ্ড’ নামে এক জলাশয়। প্রাচীন বাণিজ্যপথ সিল্ক রুটের একটি রাস্তা গিয়েছিল নেপালের দিকে এবং অন্যটি চিলাপাতার জঙ্গল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে চাপগড় পরগনার মধ্যে বিস্তৃত ছিল। সেখানেই পরে জল্পেশ মন্দির গড়ে ওঠে বলে অনুমান করা হয়। কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের বাবা বিশ্ব সিংহ ১৫২৪ সালে প্রথম এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন মন্দিরটি ভূমিকম্পে ভেঙে যায়। ১৫৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৬৩২ সালে ওই মন্দিরের উপরেই নতুন শিব মন্দির তৈরি করতে শুরু করেন কোচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ। ১৬৬৫ সালে সেই কাজ শেষ করেন তাঁর ছেলে মোদ নারায়ণ। পরবর্তীতে মন্দিরটি বৈকুণ্ঠপুরে রায়কতদের তত্ত্বাবধানে আসে। ১৮৯৯ সালের ৩০শে জানুয়ারি রাজা জগেন্দ্রদেব রায়কতের স্ত্রী রানি জগদেশ্বরীদেবী মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।  

২) জটিলেশ্বর মন্দির

গবেষকদের মতে, জটিলেশ্বর মন্দিরটি পাল যুগে নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার অনেকেই বলেন এটি গুপ্তযুগে নির্মিত হয়েছিল। ময়নাগুড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জলঢাকা নদীর কাছে জটিলেশ্বের মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি নবম শতকের বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অর্থাৎ মন্দিরের বয়স হাজার বছরেরও বেশি। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। শ্রাবণ ও ফাল্গুন মাসে জটিলেশ্বরে বিপুল ভক্ত সমাগম হয়।

৩) মহাকাল শিবমন্দির

উত্তরবঙ্গের আরও এক বিখ্যাত শিব মন্দির রয়েছে দার্জিলিং জেলায়, যা মহাকাল মন্দির নামে পরিচিত। এখানকার প্রধান বৈশিষ্ঠ হল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সহাবস্থান; মন্দিরের গর্ভেই ভগবান শিবের পাশে রয়েছেন বুদ্ধদেব। লামা দোর্জে রিংজিং ১৭৮২ সালে এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই দোর্জের নাম থেকে দার্জিলিং জনপদের নামকরণ করা হয়েছে, বৌদ্ধ সন্যাসীরাই ‘দোর্জে’ ও ‘লিং’ শব্দ দুটি মিলিয়ে এই জায়গার নাম রেখেছেন দার্জিলিং থেকে যার অর্থ বজ্রের দেশ।

এবার দক্ষিণবঙ্গে আসা যাক…

৪) তারকেশ্বর মন্দির

বাংলার অন্যতম প্রধান শৈবভূমি হল হুগলির তারকেশ্বর। এই মন্দির নিয়ে তো বাঙালি আস্ত একটা সিনেমাই বানিয়ে ফেলেছে। এখানে শিব বাবা তারকনাথ নামে পূজিত হন। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, রাজা ভরমল্ল স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তারপরই জঙ্গল থেকে একটি শিবলিঙ্গ পান তিনি। এরপর ১৭২৯ সালে গড়ে ওঠে বাবা তারকনাথের মন্দির। মন্দিরের পাশে রয়েছে একটি জলাশয়, যা দুধপুকুর নামে পরিচিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তারকনাথ খুবই জাগ্রত।

৫) ঘণ্টেশ্বর মন্দির

হুগলি জেলারই আরেক বিখ্যাত শিব মন্দির হল খানাকুলের বাবা ঘণ্টেশ্বরের মন্দির। সতীপীঠ রত্নাবলী মন্দিরের কাছেই বাবা ঘণ্টেশ্বরের অবস্থান। শোনা যায়, বহুকাল আগে খানাকুলেরই আশেপাশের কোন এক গ্রামের বাসিন্দা বটুক কারকের একটি গরু একটি শিমূল গাছের পাশে প্রতিদিন দুধ দিত। গরুটি কোনদিনই বাড়িতে দুধ দিত না। প্রতিদিন একই ঘটনা দেখে কৌতুহলেরবশত তিনি একদিন ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি খনন করতে শুরু করেন। কিছুটা মাটি খুঁড়তেই বাবা ঘণ্টেশ্বরের দেখা মেলে। পরবর্তীকালে ওখানেই গড়ে ওঠে ঘণ্টেশ্বর মন্দির।

৬) রাঢ়েশ্বর মন্দির

সম্রাট বল্লাল সেন রাঢ়েশ্বর শিবমন্দিরটি দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি করেন। মন্দিরটি পীরা দেউল গৌড়ীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত, বেলে ও ঝামা পাথর দিয়ে তৈরি। পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে মন্দিরটি অবস্থিত। শিবরাত্রিতে এই মন্দিরে শিব-পার্বতীর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। শিবের বরযাত্রীরা পানাগড়ের বিশ্বকর্মা মন্দির থেকে পানাগড় দার্জিলিং মোড়ে অবস্থিত রাঢ়েশ্বর শিবমন্দিরে আসে। এখানে শিব-পার্বতীর বিয়ে দেওয়া হয়। বরপক্ষ ও কনেপক্ষের জন্য খিচুড়ি ভোগের ব্যবস্থা করা হয়।

৭) এক্তেশ্বর মন্দির

বাঁকুড়া জেলায় দ্বারকেশ্বরের তীরে এক্তেশ্বর মন্দির অবস্থিত। ইতিহাস অনুসারে, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। শোনা যায়, মন্দিরের শিবলিঙ্গটি নাকি অনেকটা মানুষের পায়ের মতো দেখতে। কেউ কেউ বলেন, এক্তেশ্বর মন্দিরে ভগবান শিবের একপদবিশিষ্ট মূর্তি পূজিত হয়। তাই অনেকেই এক্তেশ্বরকে একপদেশ্বরও বলে থাকেন। যদিও মন্দিরের বর্তমান শিবলিঙ্গটি একপদেশ্বরের নয়। 

৮) ব্যাসদেব মন্দির

প্রথমেই বলি এখানকার ব্যাসদেব হলেন আদপে শিব। মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজারের ব্যাসপুরে এই শিব মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছেন পাঁচ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। যার নাম ব্যাস দেব।
পণ্ডিত রামকেশব দেবশর্মন ১৮১১ সালে এই মন্দির তৈরি করেন। মনে করা হয়, রাণী ভবানীর তৈরি বরানগরের মন্দির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই মন্দির তৈরি হয়েছে। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ ভক্তদের মুগ্ধ করে। কালের নিয়মে মন্দিরটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে ১৯১৮ সালে মুর্শিদাবাদের লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর মন্দিররের সংস্কার করেন।

৯) নদীয়ার শিবনিবাস

নদীয়া জেলার শিবনিবাসকে বাংলার কাশী বলা হয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চুর্ণী নদী। জনশ্রুতি রয়েছে যে, শিব মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে হাজির হয়ে বলেছিলেন যে, তিনি কাশি থেকে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করছেন। তাই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসে শিবের নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ১০৮ টি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। 
তবে ইতিহাসবিদেরা বলেন, আঠারো শতকের মাঝামাঝি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বর্গি আক্রমণের হাত থেকে কৃষ্ণনগরকে রক্ষা করার জন্য এটিকে শিবনিবাসে স্থানান্তরিত করেন। মহারাজাই সম্ভবত শিবনিবাস নামকরণ করেন। যদি প্রচলিত বিশ্বাস, এটি মহাদেব নিজেই করেছেন। আবার অনেকে বলেন, এই নামটি তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের নামে রাখা হয়েছিল। এই মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে নানান ধরনের সাংস্কৃতিক মিশেল দেখা যায়। এখানের সবচেয়ে বড় শিব মন্দিরটি বুড়ো শিব নামে পরিচিত। চূড়াসহ মন্দিরের উচ্চতা ১২০ ফুট। মন্দিরের ভেতরের শিবলিঙ্গটি পূর্ব ভারতের সবচেয়ে উচ্চতম শিবলিঙ্গটি রয়েছে। শিবনিবাসের মন্দিরগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন – রাজ রাজেশ্বর মন্দির, রগনিশ্বর মন্দির, রাম-সীতা মন্দির, বুড়ো শিব মন্দির ইত্যাদি। যদিও বর্তমানে এখানে ১০৮টির মধ্যে মাত্র তিনটি মন্দির অবশিষ্ট রয়েছে।

১০) কালনার ১০৮ শিবমন্দির

বাংলার শৈবক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল বর্ধমানের নবাবহাটের ১০৮ শিবমন্দির। মহারানি বিষ্ণুকুমারীদেবী ১৭৮৮ সালে প্রথম এই ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করেন। এই মন্দিরটি আয়তাকার। পরবর্তীকালে ১৮০৯ সালে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর কালনায় আরও একটি ১০৮ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কালনার ১০৮টি শিবমন্দিরটি অবশ্য গোলাকৃতি। বর্তমানে গোটা ভারতবর্ষে কেবল মাত্র এই দুই জায়গাতেই ১০৮ শিবমন্দির রয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen