সংসদের কড়চা, সপ্তম দিন: প্রশ্নবাণে বিদ্ধ কেন্দ্র, বাংলার বঞ্চনা প্রকাশ্যে আনল তৃণমূল সাংসদেরা
মানস মোদক

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৯:৩০: সোমবার সংসদের উভয় কক্ষে একাধিক ইস্যুতে মোদী সরকারকে (Modi Govt) রীতিমতো কোণঠাসা করলেন তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) সাংসদরা। ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা, বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিলে বাংলার প্রতি বঞ্চনা এবং বিভিন্ন মন্ত্রকে বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ নিয়ে তৃণমূল সাংসদদের করা প্রশ্নের উত্তরে উঠে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
লোকসভা
বাংলার প্রতি আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ
এদিন লোকসভায় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) এবং সাংসদ আবু তাহের খান (Abu Taher Khan) মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম (MGNREGS) বা ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সরকারের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে মজুরি ও উপাদান বাবদ কেন্দ্রের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা (প্রায় ৯,৪০০ থেকে ১০,০০০ কোটি টাকার বেশি) বকেয়া রয়েছে। তবুও বাংলা ছাড়া সেই রাজ্যগুলিতে কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করছে।
অন্যদিকে, বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিলের ক্ষেত্রে বাংলার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের(Mahua Moitra) প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের কাছে ৬৭,৭২১ কোটি টাকা দাবি করলেও কেন্দ্র দিয়েছে মাত্র ৪,৬১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দাবির মাত্র ৭ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
গুজরাট বনাম বাংলা- বরাদ্দে বৈষম্য
সাংসদ বাপি হালদারের (Bapi Haldar) প্রশ্নে দুগ্ধ ও পশুপালন পরিকাঠামোয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড়সড় বৈষম্যের চিত্র সামনে এসেছে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ডেয়ারি ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা দুগ্ধ পরিকাঠামো খাতে কেন্দ্র ১,৩০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। এর মধ্যে গুজরাট একাই পেয়েছে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের জুটছে মাত্র ৭১ লক্ষ টাকা।
মন্ত্রকে বিপুল শূন্যপদ
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে কর্মী নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মিতালী বাগ (Mitali Bag), ইউসুফ পাঠান (Yusuf Pathan), রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Rachna Banerjee) এবং ডা. শর্মিলা সরকার (Dr. Sharmila Sarkar)।
সরকারের দেওয়া উত্তরে দেখা যাচ্ছে:
* সমবায় মন্ত্রকে (Ministry of Cooperation) ৪৪ শতাংশ পদ খালি।
* মৎস্য, পশুপালন ও দুগ্ধজাত মন্ত্রকে প্রায় ১৯ শতাংশ পদ শূন্য। মৎস্য দপ্তরেই ২২ শতাংশ শূন্যপদ রয়েছে।
* সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকে ১৭ শতাংশ পদ খালি পড়ে আছে।
কৃষক ও স্বাস্থ্য সমস্যা
সাংসদ জুন মালিয়া (June Maliah) জানান, পিএম কিষান (PM Kisan) প্রকল্পে ৩১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার কৃষকের এখনও ‘ফার্মার আইডি’ নেই, যার মধ্যে উত্তরপ্রদেশেই ১.১৯ কোটি কৃষক এই তালিকায় রয়েছেন।
এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্ন ও অন্যান্য ইস্যু
তৃণমূল সাংসদদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর সরকার এড়িয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে সাংসদ দেবের (Deepak -Dev Adhikari) তোলা আধার কার্ড না থাকায় সুবিধা থেকে বঞ্চনার বিষয় এবং সায়নী ঘোষের (Sayani Ghosh) তোলা ভারতের চাষযোগ্য মাটির গুণমান সংক্রান্ত প্রশ্ন। এছাড়া সাংসদ পার্থ ভৌমিক ও সাজদা আহমেদ (Partha Bhowmick and Sajda Ahmed) সরকার খাদ্যশস্য ও চিনি শিল্পে বাধ্যতামূলকভাবে খাদ্যশস্যের জন্য ১০০ শতাংশ এবং চিনির জন্য ২০ শতাংশ পাটের বস্তা ব্যবহারের অডিট নিয়ে প্রশ্ন করলে সরকার স্পষ্ট উত্তর দেয়নি।
রাজ্যসভা
আজ সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভাতেও তৃণমূল (AITC) সাংসদদের প্রশ্নের মুখে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ল কেন্দ্রীয় সরকার। ডেরেক ও’ব্রায়েন, সাগরিকা ঘোষ, মৌসম নুর-সহ একাধিক তৃণমূল সাংসদের মোট ৯টি প্রশ্নের লিখিত উত্তরে উঠে এসেছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ব্যর্থতা এবং বিস্ময়কর সব পরিসংখ্যান।
তৃণমূল সাংসদদের প্রশ্নের উত্তরে সরকারের দেওয়া তথ্যে যে প্রধান বিষয়গুলি উঠে এসেছে
১. বায়ুদূষণে মৃত্যু নেই!
সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের (Derek O’Brien) প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, দেশে বায়ুদূষণের কারণে সরাসরি কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদরা যখন বায়ুদূষণকে ‘নীরব ঘাতক’ বলছেন, তখন সরকারের এই দাবি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
২. ব্যর্থ ‘পিএম ইন্টার্নশিপ স্কিম’ ও জমছে আরটিআই আপিল
সাংসদ সাগরিকা ঘোষের (Sagarika Ghose) দুটি প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে।
* প্রথমত, ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু হওয়া ‘প্রধানমন্ত্রী ইন্টার্নশিপ স্কিম’ বা পিএম ইন্টার্নশিপ প্রকল্পের বেহাল দশা প্রকট হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ০.৫৭ শতাংশ অর্থ এখনও পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
* দ্বিতীয়ত, তথ্যের অধিকার আইন বা RTI-এর ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রিতা বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষ থেকে ‘ফার্স্ট অ্যাপেলেট অথরিটি’র (First Appellate Authority) কাছে বকেয়া আপিলের সংখ্যা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. এফসিআই-এর বিপুল ক্ষতি
সাংসদ মহম্মদ নাদিমুল হকের (Mohammed Nadimul Haque) প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (FCI)-র পরিবহণ বা ট্রানজিটে ক্ষতির পরিমাণ উদ্বেগজনক। ২০২১-২২ সাল থেকে পরিবহণের সময় ১৪০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের খাদ্যশস্য নষ্ট বা ক্ষতি হয়েছে।
৪. স্বাস্থ্য খাতে পকেটে চাপ
সাংসদ সামিরুল ইসলামের (Samirul Islam) প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছে, দেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৪০ শতাংশই সাধারণ মানুষকে নিজেদের পকেট (Out-of-pocket expenses) থেকে খরচ করতে হয়, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের ওপর বড়সড় আর্থিক বোঝা।
৫. সারের ঘাটতি ও ডিএপি সংকট
কৃষিক্ষেত্রে সারের জোগান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইক (Prakash Chik Baraik)। উত্তরে জানা গেছে, দেশে ডিএপি (DAP) সারের যা মোট চাহিদা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে তার মাত্র ৩৫ শতাংশ মেটানো সম্ভব হচ্ছে। বাকিটা আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
৬. জিএসটি ব্যবস্থায় ত্রুটি স্বীকার
সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Ritabrata Banerjee) প্রশ্নের জবাবে সরকার পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি-র ই-ওয়ে বিল (e-way bill) ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত ত্রুটি বা সিস্টেমিক ডেফিসিয়েন্সির (systemic deficiencies) কথা স্বীকার করে নিয়েছে।
৭. গোল্ড বন্ডে সুদের বোঝা
সাংসদ সাকেত গোখলের (Saket Gokhale) প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত ‘সোভেরেন গোল্ড বন্ড’-এর সুদ বাবদ সরকারের কোষাগার থেকে মোট ৬,০৫৫.৩৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
৮. থমকে শিপিং কর্পোরেশনের বিলগ্নিকরণ
সাংসদ মৌসম নুরের (Mausam Noor) প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার কৌশলগত বিলগ্নিকরণের (strategic disinvestment) কথা ঘোষণা করা হলেও, দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি।
আজকের প্রশ্নোত্তর পর্বে তৃণমূল সাংসদদের এই প্রশ্নবাণ কার্যত মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক গাফিলতিকেই জনসমক্ষে তুলে ধরল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।