কৃপাময়ী থেকে বুলবুলচণ্ডী, বাংলার ঐতিহাসিক দশ কালীর কাহিনি
দক্ষিণ দিনাজপুরের বোল্লা রক্ষাকালী: দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বোল্লা গ্রামে বোল্লা কালী মন্দির অবস্থিত। জনশ্রুতি মতে, দেবীর নামটি এসেছে বোল্লা গ্রাম থেকে। সম্ভবত, জমিদার বল্লভ মুখোপাধ্যায়ের নাম থেকেই এই গ্রামের নামকরণ হয়েছিল। বোল্লা কালী পুজোর ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। কথিত আছে, একজন স্থানীয় মহিলা স্বপ্নে দেবীর দর্শন পেয়ে এই স্থানে একটি কালো পাথর খণ্ড খুঁজে পান। মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ হল সাড়ে সাত ফুটের দেবী প্রতিমা, দেবীকে সাজানো হয় কুড়ি কেজি সোনা দিয়ে, হাতে থাকে আড়াই টনের সোনার রামদাঁ।
মালদহের হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডী কালীপুজো: মালদহের বুলবুলচণ্ডী কালীপুজো চলে টানা ১৩ দিন ধরে। ১৪তম দিনে দেবীর বিসর্জন হয়। এক সময়ে নাকি এই পুজোয় ৪৮ ফুটের প্রতিমা তৈরি হত। পরে অবশ্য স্থায়ী মন্দির তৈরি হওয়ায় কমিয়ে ৪২ ফুটে নামিয়ে আনা হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরে ক্ষীরপাইয়ের বড় মা কালী: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষীরপাই গ্রামের দেবী কালী 'বড় মা' নামে পরিচিত। বড় মা-র উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। প্রতিমার চার হাতের মধ্যে উপরের একটি হাতে রয়েছে পৃথিবীর প্রতিকৃতি। দেবীর নীচের একটি হাতে ধরা আছে একটি সাদা পায়রা। মূল মন্দির চত্বরে আরও একটি ছোট মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরের দেবী ছোট মা নামে পরিচিত।
বাঁকুড়ার মাইতো কালী: বাঁকুড়ার সোনামুখীর অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় কালীপুজো হল মাইতো কালী। কথিত আছে, ১৭৮২ সালে একদিন সোনামুখী রানিরবাজারের কালী মন্দিরে বৃদ্ধ সেবায়েত সন্ধ্যারতি করছিলেন। তিনি যখন হাঁড়িকাঠে প্রণাম করছিলেন তখন বর্গি সর্দার ভাস্কর পন্ডিত তাঁকে বলি দিতে যান। শূন্যেই খাঁড়া আটকে যায়। দৃষ্টি হারান তিনি। সবটা বুঝতে পারেন বৃদ্ধ সেবায়েত। তখন ঘট থেকে জল নিয়ে বৃদ্ধা ছিটিয়ে দেন ভাস্কর পন্ডিতের উপর। দৃষ্টি ফিরে পেয়ে, সুস্থ হয়ে তিনি জানতে চান কোন দেবী বিরাজ করছেন? জবাবে বৃদ্ধ সেবায়েত জানান এখানে মা কালী রয়েছেন। শুনে ভাস্কর পন্ডিত বলে ওঠেন, মা-ই তো কালী হ্যায়। সেই থেকে দেবীর নাম হয় ‘মাইতো কালী’।
নবদ্বীপের পোড়ামাতলার কালী মন্দির: নবদ্বীপ পোড়ামাতলায় রয়েছে দেবী কালীর মন্দির। বিরাট এক বটগাছের তলায় এই মন্দির, দিনের বেলাতেও আলো পৌঁছয় না এখানে। এই বটগাছ এক সময়ে নাকি বজ্রপাতের কারণে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে এখানকার দেবী পোড়া মা নামে পরিচিত।
কাটোয়ার মুস্থূলীর বোলতলা কালীপুজো: পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার মুস্থূলী গ্রামে বোলতলা কালীপুজো খুবই বিখ্যাত। স্থানীয়দের কাছে দেবী ‘মেজঠাকরুন’ নামেই পরিচিত। পুজোর বয়স তিনশো বছরের বেশি। কথিত আছে, বহু বছর আগে এক সাধক এই গ্রামের এক বকুল গাছের নীচে ছোট্ট মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে কালীর আরাধনা শুরু করেন। সেই বকুলতলার কালীই পরে ‘বোলতলা কালী’ নামে খ্যাত হন।
কৃপাময়ী কালীমন্দির: বরাহনগরের জয় মিত্র কালীবাড়ির কৃপাময়ী কালী অত্যন্ত জাগ্রত। ১৮৪৮ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জমিদার জয়রাম। রামকৃষ্ণ একে মাসি বলে ডাকতেন। বলা হয়, কৃপাময়ী কালী হলেন দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর বোন।
সেবকেশ্বরী কালীমন্দির: শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকগামী ৩১নং জাতীয় সড়কের ধারে সেবক পাহাড়ে অবস্থিত সেবকেশ্বরী কালী মন্দির। সেবক পাহাড়ের নামে নামাঙ্কিত এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন নেপালের ভক্তরাও। সেবকের মূল রাস্তা থেকে ১০৭টি সিঁড়ি বেয়ে এই কালী মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। কালীপুজোর রাতে, শিলিগুড়ি, সিকিম, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কালিম্পং সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীর ঢল নামে।
সিঙ্গুরের ডাকাতকালী মন্দির: প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ বছর আগে গড়ে ওঠা সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দির ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। বৈদ্যবাটি তারকেশ্বর রোডের পাশে পুরুষোত্তমপুর এলাকায় এই ডাকাত কালী মন্দির অবস্থিত। আদতে এটি সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। ডাকাত সনাতন বাগদী না গগন সর্দার না-কি রঘু ডাকাত, কে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কথিত আছে, অসুস্থ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দেখতে যাওয়ার পথে সারদা দেবীকে এই স্থানে দুই ডাকাত আটক করলে স্বয়ং কালী দেখা দেন ও তাঁকে রক্ষা করেন।
শান্তিপুরের আগমেশ্বরী কালী: ৪০০ বছরের প্রাচীন তান্ত্রিক পুজো শান্তিপুরের আগমেশ্বরী কালী। শোনা যায়, শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য্যের প্রপৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে এই পুজো শুরু হয়েছিল। মথুরেশ তাঁর বসতবাটির থেকে কিছুটা দূরে একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে পুজো শুরু করেন। এই স্থানটিই বর্তমানে আগমেশ্বরীতলা নামে পরিচিত। সেখানেই সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ।