করোনা আবহে পুজোর মরসুমেও বিপন্ন বস্ত্রশিল্প

খুচরো ব্যবসায়ীরা হাটে না এলে মানিকবাবুরাও যাবেন না শওকতদের কাছে। কোভিডের দৌরাত্ম্যে বস্ত্রব্যবসার এই চিরায়ত শৃঙ্খল ভেঙে চুরমার।

August 6, 2020 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

‘এখন হাতে খুব একটা কাজ নেই। সকাল শুরু হয়ে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। অর্ডার পাচ্ছি না। তবে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লে বস্ত্রশিল্প ঠিক ঘুরে দাঁড়বেই। তার আগে বাজারে ভ্যাকসিন চলে এলে তো আর কথাই নেই।’ বলছিলেন মেটিয়াবুরুজের শওকত নুর আলম। আশা… নাকি আর্তি! জানা নেই। জানেন না তাঁরাও। শুধু অপেক্ষা…। কথা হচ্ছিল ধর্মতলা চত্বরের এক নামজাদা টেলারিং সংস্থার কর্ণধারের সঙ্গেও। পোশাক-আষাকের বিপণীও রয়েছে তাঁর। বলছিলেন, ‘প্রতি বছর ১৫ আগস্টের মধ্যে বাজারের হাবভাব বুঝে যাই। ওইদিন থেকে আমরা আর অর্ডার নিতে পারি না। প্রচণ্ড কাজের চাপ পড়ে যায়। এবার সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। বস্ত্রশিল্পের সেই সুদিন আর ফিরবে কি না জানি না!’

মেটিয়াবুরুজ কিংবা ধর্মতলা চত্বর। এখান থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গার্মেন্টস পার্ক অথবা হাওড়ার মঙ্গলা হাট। আলাদা মেরু। কিন্তু খাদের অতলে যে সবাই। আশা-নিরাশার দোলাচলে বিপন্ন বস্ত্রশিল্প। উৎপাদন কেন্দ্রে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে… অর্ডার নেই। আবার বিপণনকেন্দ্রে ঢুঁ মারলে আক্ষেপের সুর­—‘বাজারে ক্রেতা নেই। অর্ডার দিয়ে লাভ কী?’ চাহিদা-জোগানের এই সহজ অঙ্ক এতটা কঠিন রূপে রুজিরুটি ছিনিয়ে নেবে, বুঝতে পারেনি দর্জিমহল। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, লকডাউন উঠে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, ফিরে আসার পথ বড্ড কঠিন!

কোভিড মহামারী এখন শিক্ষা দিচ্ছে—আগে পেটের ভাত। তার অনেক পরে বস্ত্র। তাও আবার অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া একদম নয়। ফলে পুজোর কাউন্টডাউন প্রায় শুরু হয়ে গেলেও বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যস্ততা নেই। সে স্পেশালিস্ট দর্জি হোক, কিংবা পাড়ার দোকান। চিত্রটা সর্বত্র সমান। ধুঁকছে ছিট কাপড়ের ব্যবসাও। তবে আশা জোগাচ্ছে কোভিডের ভ্যাকসিন। এ বছর পুজোর প্রায় মাস খানেক আগে মহালয়া। অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন… যদি তার আগে বাজারে ভ্যাকসিন চলে আসে! তখন বস্ত্রশিল্প চাঙ্গা হতে আর বেশি সময় লাগবে না। এমন আশাতেই এখন বুক বাঁধছেন ব্যবসায়ী থেকে কারিগররা।

আর ভ্যাকসিনের সঙ্গে বস্ত্র ব্যবসার অঙ্ক যদি না মেলে? ওয়েস্টবেঙ্গল গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বিজয় কারিওয়ালার মতে, ‘সে ক্ষেত্রে পুজোয় ছোটদের পোশাক হয়তো বিক্রি হবে। কিন্তু বড়দের হ্যাল ফ্যাশনের পোশাক বিক্রিতে কোনও আশা দেখছি না।’ তিনি বলছিলেন, পূর্ণ লকডাউনে ব্যবসা লাটে উঠেছে। আনলকেও বাজারে লোক নেই। দোকান খুললেও সংক্রমণের ভয়ে ক্রেতা আসছেন না। অভিজ্ঞতা বলছে, জুন-জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই মূলত পোশাক বিক্রির ধুম পড়ে। এবার তার ছিটেফোঁটাও নেই।’ কারিওয়ালার আশঙ্কার ছবি ধরা পড়ল দক্ষিণ ২৪ পরগনার গার্মেন্টস পার্কে। ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করেন এখানে। এখন মাত্র ২০ শতাংশ লোক কাজ করতে আসছেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ শ্রমিকই কার্যত হাত গুটিয়ে। এবং এই মুহূর্তে সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছেন শ্রমিকরা।

কেন? চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য নেই। হাওড়া মঙ্গলা হাট। পোশাক বিক্রির পাইকারি বাজার। শেষবারের মতো বেচাকেনা হয় গত ১৯ মার্চ। তারপর একপ্রকার গৃহবন্দি ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলা হাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মানিক সাহার কথায়, ‘গত মাসেও কয়েকজন মিলে বাজার খুলেছিলাম। কিন্তু কোনও ক্রেতা নেই। বাজার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। অন্যান্য বছর এই সময় পুজোর মাল কিনতে অসম, ত্রিপুরা থেকে ব্যবসায়ীরা চলে আসেন হাওড়ায়। এবার তাঁরা ফোন পর্যন্ত করেননি। পুজোর পর পরই দশেরা ও ছট পুজো। বিহারের বস্ত্র বিক্রেতারাও আগস্ট মাস থেকেই এখানে ভিড় জমাতেন। এখনও তাঁদের দেখা মিলছে না।’

অতঃপর, খুচরো ব্যবসায়ীরা হাটে না এলে মানিকবাবুরাও যাবেন না শওকতদের কাছে। কোভিডের দৌরাত্ম্যে বস্ত্রব্যবসার এই চিরায়ত শৃঙ্খল ভেঙে চুরমার।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen