উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী – এক বহুমুখী প্রতিভা

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালা বাদক ও সুরকার।

December 20, 2020 | 2 min read
Published by: Drishti Bhongi

বেশ মেধাবী ছাত্র ছিলেন কামদারঞ্জন রায়। কিন্তু ওই নামে কেউ আর তাঁকে চেনেন না আজ। সবার কাছে তিনি পরিচিত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। নাম বদলের পেছনে একটি ঘটনা আছে। সেটা বলা যাক। কামদারঞ্জনের বাবা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন পুরুষ। আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে ছিলেন সুপণ্ডিত। ডাকনাম ছিল তাঁর শ্যামসুন্দর মুন্সী। কামদারঞ্জন ছিল শ্যামসুন্দরের আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। 

জন্ম তাঁর ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ, অর্থাৎ ১৮৬৩ সালের ১০ মে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। বাবার ঘরে কামদারঞ্জন বেড়ে উঠছিলেন অন্য ছেলেদের মতো করেই। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তাঁর বাবার এক পুত্রসন্তানহীন আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নেন কামদারঞ্জনকে। ওই পরিবারে গিয়ে কামদারঞ্জনের নতুন নামকরণ হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। স্কুলের পরীক্ষাতেও বেশ ভালো ফল করতেন সবসময়। কিন্তু তারপরও ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ছিল তাঁর অনাগ্রহ। বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশি, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান তিনি। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ২১ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। ওই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হন। এর ফলে অনেক আত্মীয়র সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে তাঁর।

ছাত্র থাকাকালেই উপেন্দ্রকিশোর  ছোটদের জন্য লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘মুকুল’ এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ নামে মাসিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ হতে শুরু হয় তাঁর লেখা। প্রথম দিকের যেমন : সখায় (১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলো ছিল জীববিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ। তারপর প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয় চিত্র-অলঙ্করণযুক্ত গল্প। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন, টুনটুনির বই ইত্যাদি তাঁরই অমর সৃষ্টি।

১৮৮৬ সাল। ২৩ বছরের উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে বিধুমুখীর সঙ্গে। তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে লাহাদের বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে সংসার-জীবন শুরু হয় উপেন্দ্রকিশোরের। তাঁর ছিল তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন- সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল এবং মেয়েরা হলেন- সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।

উপেন্দ্রকিশোরের প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে। এই বই সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হয়। কিন্তু বইটির মুদ্রণ নিয়ে অত্যন্ত অসন্তোষ থাকায় ১৮৮৫ সালের দিকে তিনি বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন কলকাতায়। সেই সঙ্গে ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামের নতুন ছাপাখানা খোলেন। সেখানের একটি কামরায় উপেন্দ্রকিশোর নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে। ১৯১১ সালে তিনি তাঁর বড় ছেলে, বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়কে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য।

শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালা বাদক ও সুরকার। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন, যা পরে তাঁর বড় ছেলে সুকুমার রায় ও নাতি, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার-লেখক সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হন উপেন্দ্রকিশোর।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen