বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

ভালবাসার সাত রঙ

February 14, 2022 | 3 min read

আজ ভালবাসার দিন। এই পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্কের বুনিয়াদ হল ভালবাসা। ​ভালবেসে, ভালবাসায় বেঁধে রাখাই তো ভালবাসা।

মানব প্রেম বা জীবে প্রেমের বাণী তো ছড়িয়ে রয়েছে সব ধর্মেই। চৈতণ্যদেব থেকে পরমহংস দেব, পদাবলীর পদ থেকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন সর্বত্রই প্রেমের জয়জয়াকার। ভালবাসা কী কেবল নারী আর পুরুষের হয়? সমলিঙ্গে কী ভালবাসা হতে পারে না?


আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সমস্যা অনেক, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবা একটা সাধারণ বিষয়কে সমাজের চোখে ট্যাবু বানিয়ে ছেড়েছে।
হলদে গোলাপ পড়েছেন? সমান্তরাল বা নগর কীর্তন দেখেছন?

সমাজ যাদের দেখে নাক সিটকোয়, যাদের হাসির খোরাক বানায় তারাও তো মানুষ। মানুষের শরীর তো যন্ত্র নয়, তার একটা মন রয়েছে। আবেগ-অনুভূতি হল সেই মনের ভাষা। এমনটা হতেই পারে যে নারীদেহে বেড়ে ওঠে পুরুষ মন। আবার পুরুষ দেহ কাঠামোতে লুকিয়ে থাকে নারী মন। নারীসুলভ সেই পুরুষদের বা পুরুষোচিত সেই নারীর জন্য সমাজ ছুড়ে দেয় একরাশ বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ। কখনও উল্টো দিকের চিন্তা করা হয় না! এক সাধারণ জীবনকে সমাজ বদ্ধমূল ধারণা বশবর্তী হয়ে ধীরে ধীরে আঁধারে ঠেলে দেয়। সমকামী, উভকামী, ভিন্ন লিঙ্গের মানুষদেরও তো প্রেমে পরার অধিকার রয়েছে। দিন বদলেছে, আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে সমাজ। কিন্তু এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি।

ভালবাসার আবেদনে সাড়া দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, ১৫৬ বছর ধরে চলে আসা নিপীড়ন থেকে মুক্ত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, এখন আর সমকামিতা অপরাধ নয়। ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া ১৮৬১ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩৭৭ ধারায় সমকামী যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। ৩৭৭ আজ আর নেই। অসাংবিধানিক বলে খারিজ হয়ে গিয়েছে।

মুম্বইয়ে সমকামী ছেলের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন মা। রূপান্তরিতা মানবী কলেজের অধ্যক্ষা হচ্ছেন। পাল্টাচ্ছে সমাজ। সাবলম্বী হচ্ছে মানুষের মন। ইরফান খানের ছেলে প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন তিনি সমকামী। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সমকামী বিবাহও হচ্ছে, দীর্ঘ লড়াই করে নিজের সমকামী সঙ্গীকে আপন করে নিলেন মার্কিন প্রবাসী ঋষি মোহনকুমার সাথাওয়ান। আইআইটি বম্বের বি-টেক করা ঋষি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত। তিনি মার্কিন নাগরিক। বিগত ৩০ ডিসেম্বর ভিয়েতনামের বাসিন্দা ভিনের সঙ্গে বিয়ে সেরেছেন তিনি। প্রথমে এই বিয়েতে ঋষির পরিবার, বন্ধু-পরিচিতদের আপত্তি ছিল। অনেক বাধাও এসেছিল। কিন্তু, ছেলের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত ঋষির পরিবার বিয়েটা মেনে নেন। ধুমধাম করে মহারাষ্ট্রের যবতামলে মরাঠি রীতি মেনে ভিনকে বিয়ে করেছেন ঋষি। যদিও এর আগে আমেরিকাতেও ভিনকে একবার বিয়ে করেন ঋষি।

বিগত বছরের জুলাই মাসের কথা। তেলেঙ্গানা সেবার এক ব্যতিক্রমী বিয়ের সাক্ষী থেকেছে। বিবাহ অনুষ্ঠানে দুজনই বরের বেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেছেন দুই সমকামী পুরুষ। ৩৪ বছরের তেলেঙ্গানার বাসিন্দা অভয় দাঙ্গের সঙ্গে ৩১ বছর বয়সী বাঙালি যুবক সুপ্রিয় চক্রবর্তী গাঁটছড়া বাঁধেন। হায়দরাবাদের বাঙালি যুবক সুপ্রিয় এবং পাঞ্জাবি যুবক অভয় দুজনেই বর্তমানে আইটি ক্ষেত্রে কর্মরত। ​এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে হয় তাদের। আনুষ্ঠানিক বন্ধনের সমগ্র আয়োজন করেছিলেন সমকামীযুগলের বন্ধু তথা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্য সোফিয়া ডেভিড।

২০২১ এর ডিসেম্বরে পঞ্জাবও ভিন্ন ধর্মী এক বিয়ে সাক্ষী থেকে গেল। নিজের তুতো বোনকে বিয়ে করলেন তার দিদি। পূর্ণতা পেল নারী সমকামিতা। সমগ্র বিয়ে হিন্দু ধর্মের যাবতীয় প্রথা মেনেই সম্পন্ন হয়েছে। কন্যা দান থেকে শুরু করে মালাবদল করছেন ওই যুগল, সিঁদুর দান সবই নিয়ম মেনে, অগ্নি সাক্ষী করে পুরোহিতের সামনে মন্ত্রোচ্চারণ করে সাড়া হয়েছে বিয়ে। সেই সঙ্গে দুই বোনের একজনের দাদা পুরোহিতের পাশে বসে কন্যাদান করছেন। বিয়ের আসরে একজনের গলায় মঙ্গলসূত্রও দেখা গিয়েছে। খুব স্বল্প অংশের মধ্যে হলেও একটু একটু করে সমকামিতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।
​​
সমকামিতার গল্প উঠে আসছে ভারতীয় চলচ্চিত্রেও। কারণ চলচ্চিত্রের কাজ সময়কে প্রতিফলন করা।
সাম্প্রতিক ছবি বধাই দো-তে দু’টি সমকামী মানুষের ভালবাসা ও লড়াই এবং মানিয়ে নেওয়ার সঙ্গে প্রতিবাদের গল্প বলা হয়েছে। সমকমিতা নিয়ে ছবি আগেও হয়েছে আয়ুষ্মান খুরানা শুভ মঙ্গলম জাদা সাবধান। যে বলিউড কাল হো না হো বা দোস্তানার মতো ছবি বানিয়ে সমকামিতা নিয়ে মস্করা করেছে, সেই বলিউড দু-দশকের মধ্যে সমকামিতাকে সিরিয়াস টপিক রূপে গ্রহণ করল, যা সমাজ দর্পনের ইঙ্গিত বহন করে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ পর্দায় সমকামী পুরুষের গল্প, রূপান্তরকামীর গল্প বলে গিয়েছেন। মৈনাক ভৌমিকের ফ্যামিলি অ্যালবাম সমকামী মহিলাদের গল্প বলে। প্রায় তিন দশক আগে, নয়ের দশকের শেষ ভাগে শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশ অভিনীত দীপা মেটার ফায়ার ছবিটি মেয়েদের সমকামিতাকে উপজীব্য করে বানানো। কলকাতায় সমকামী মেয়েদের সংগঠন স্যাফো তৈরি হওয়ার পিছনে অনুঘটকের মতো কাজ করেছিল এই ছবি। ঈশা কোপ্পিকর ও নীতু চন্দ্র অভিনীত গার্লফ্রেন্ড উঠে এসেছিল সমকামিতা।

সমকামী নারীর গল্প বাংলার ছোট পর্দায়, টেলি-ছবিতে একাধিক বার উঠে এসেছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বানিয়েছেন উষ্ণ তার জন্য। রূপা এবং চূর্ণি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় ফুটে ওঠে দুই নারীর ভালবাসার গল্প। নারীদের সমলিঙ্গ প্রেমকে হাতিয়ার করে স্যাফো নিজেই উদ্যোগী হয়ে দেবলীনার পরিচালনায় ‘মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড’ আর ‘এবং বেওয়ারিশ’ নামে দুটি শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিল।

যে রুপোলি দুনিয়া কখন কমিক রিলিফ হিসেবে, আবার কখনও যৌন সুড়সুড়ি দিতে সমকামিতাকে ব্যবহার করে এসেছে, তারাও আজ সময়ের দাবিতে সমকামীদের জয়ের গল্প বলছেন। অর্থাৎ দিন পাল্টাতে শুরু হয়েছে। যেদিন থেকে সমকামিতাকে আর রোগ ভাবা হবে না, যেদিন থেকে সমলিঙ্গের প্রেমকে বাঁকা চোখে আর দেখবে না ভারতীয় সমাজ, মনকে বেড়ি পরানো হবে না, সেদিনই হবে প্রকৃতি ভালবাসার দিন।

সব অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কারকে সরিয়ে দিয়েই দেখুন না, দেখবেন ওপারে শুধুই ভালবাসা বসবাস করে। শরীর যে অবয়বই ধারণ করুক না কেন পূর্ণতা পাক মনের প্রেম। কালিদাস আষাঢ়স্য প্রথম দিবস নিয়ে পদ রেখে গিয়েছেন। কিন্তু আজ ফাল্গুনের প্রথম দিনে কী হবে? হেমন্ত নিঃশ্বাস বাংলা ছেড়ে পালাচ্ছে, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আর সেই বসন্তের আগমণে দক্ষিনা বাতাস এসে সতেজ করে দিক সব সম্পর্ককে, পৃথিবীর সব ভালবাসার সম্পর্কগুলো অটুট থাকুক।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#love, #Romance, #male, #Female

আরো দেখুন