রিলায়েন্সের টাকায় ফেসবুকে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে বিজেপি? প্রকাশ্যে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য
নির্বাচনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রচার, প্রচার সর্বস্ব বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ফেসবুক। রিলায়েন্স ব্যবসায়ীক গ্ৰুপের টাকায় ফেসবুকে বেনজিরভাবে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে বিজেপি? কেবল প্রচারই নয় আদপে চলেছে মিথ্যাচার! উঠছে প্রশ্ন। চাঞ্চল্যকর তথ্য ক্রমেই প্রকাশ্যে আসছে।
২০১৯- এর লোকসভা নির্বাচনে সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদী বলে পরিচিত প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরকে প্রার্থী করে বিজেপি। সেই সময় প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চললেও চিকিৎসার কারণে তাকে জামিন দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্রের মালেগাও মোটরসাইকেল বিস্ফোরণে, যেখানে ৬ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন প্রজ্ঞা। কিন্তু নাশকতায় অভিযুক্ত প্রার্থীর হয়ে বিজেপি মিথ্যা প্রচার করতে শুরু করে। ফেসবুক জুড়ে চালানো হয় মিথ্যে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, জামিন নয়, প্রজ্ঞা সিংহকে ওই মামলা থেকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। একদিনে ভিডিওটি ৩ লক্ষ ভিউ পায় এবং সাধ্বী প্রজ্ঞা জিতে যান।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে একটি ফেসবুক বিজ্ঞাপনে তদানিন্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর একটি বক্তব্যকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। বিজেপি ও সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র প্রসঙ্গে রাহুল বলেন, এর আগে নয়ের দশকে বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন পাকিস্তানী বেআইনি অস্ত্র কারবারি মাসুদ আজহারকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। মজা করে রাহুল আজহারকে আজহারজী সম্বোধন করেছিলেন। রাহুলের বক্তব্যের ভিডিও কেটে সেই সম্বোধনকে নিয়ে ভিন্নভাবে উপস্থান করা হয়, নির্বাচনের ১ মাস আগে ভিডিওটি তুমুলভাবে প্রচার করা হয়। মাত্র চার দিনে সাড়ে ছয় লক্ষ ভিউ পায় ভিডিওটি। ফেসবুক সূত্রে জানা গিয়েছে এনইডাবলুজে নামের একটি ফেসবুক পেজকে ওই দুটি বিজ্ঞাপন প্রচার করার জন্য পয়সা দেওয়া হয়েছিল। এনইডাবলুজে হল নিউ ইমারজিং ওয়ার্ল্ড অফ জার্নালিজম লিমিটেড, যা জিও তথা রিলায়েন্স গ্রুপের কর্ণধার মুকেশ আম্বানির অধীনস্ত সংস্থা।
একটি সংস্থার কর্ণধার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য প্রচারে জলের মতো টাকা খরচ করছে, ভারতের নির্বাচন কমিশন কী করে এ জিনিসের মান্যতা দিতে পারে? যেখানে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, নয়টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। ফেসবুকই বা কী করে তাদের নীতি বহির্ভূতভাবে এ জিনিস বরদাস্ত করে গিয়েছে। স্বাচ্ছতা রক্ষা করতে ফেসবুক কেবলমাত্র কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী দলগুলোর বিজ্ঞাপনের উপর নিয়মের বেড়াজাল চাপিয়েছে, অন্যদিকে NEWJ-এর মতো ঘুরপথে বিজেপির প্রচার করা পেজগুলোকে ছাড় দিয়েছে।
বিগত এক বছর যাবৎ দ্য রিপোর্টার’স কালেকটিভ নামের একটি সাংবাদসংস্থা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিয়ে বিশ্লেষণ করছে। ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৫৩৬,০৭০ টি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ফেসবুক নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিজেপিকে বাড়তি সুযোগ করে দিয়েছে। নির্বাচনে যার ফসল তুলেছে বিজেপি। ওই ২২ মাস সময়ের মধ্যে দেশের নির্বাচন ও নয়টি রাজ্যের নির্বাচনে বাড়তি লাভ পেয়েছে বিজেপি। রিলায়েন্সের টাকায় বিভিন্ন সংস্থা এই কাজ করে গিয়েছে।
বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের বিজ্ঞাপনকে খবরের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে, NEWJ নিজেদের একটি স্টার্টআপ বলে দাবি করে, যারা ছোট শহর ও গ্রামের মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। মূলত এরা রাজনৈতিক প্রচার করে, কিন্তু খবরের আকারে বিজেপি কেন্দ্রিক ভিডিও তৈরি করে পেজটি। ভুয়ো তথ্য, মিথ্যে খবর, মুসলমান বিরোধী মন্তব্য ছড়িয়ে দেয় একটি খবরের সংস্থাটি। বিজেপি বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধেও সরব হন এরা। ফেসবুক অ্যাড লাইব্রেরীর তথ্য বলছে লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন তিন মাসে NEWJ ১৭০ টি রাজনৈতক বিজ্ঞাপন চালিয়েছে। যার মাধ্যমে বিজেপি নেতাদের প্রচার করা হয়েছে, বিজেপিকে ভোট দেওয়ায় জন্য ভোটদাতাদের প্রভাবিত করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয় আবেগের হাওয়া তুলে বিজেপিবান্ধব পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকেও আক্রমণ করেছে NEWJ। অরাজনৈতিকভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে বিজেপির রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে গিয়েছে সংস্থাটি। ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিক তথ্যের আড়ালে ভিডিওর মাধ্যমে বিজেপির কথাই ছড়িয়ে দেওয়া হত।
NEWJ- এর প্রতিষ্ঠা শালভ উপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপি এবং রিলায়েন্স গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে। ওঁর বাবা উমেশ উপাধ্যায় রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের মিডিয়া ডিরেক্টর। এর আগে তিনি রিলায়েন্সের মালিকানাধীন সংবাদ পরিবেশনকারী সংস্থা নেটওয়ার্ক ১৮ গ্রুপের সভাপতি ছিলেন। তার এক ভাই সতীশ উপাধ্যায় হলেন বিজেপির প্রথম সারির নেতা, এবং দিল্লি বিজেপির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। এইভাবে প্রত্যক্ষভাবে বিজেপির প্রচার করলেও নির্বাচন কমিশন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ডিজিটাল প্লাটফর্মের উপর নির্বাচন কমিশন কোনরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। সে সুযোগ পুরোদমে ব্যবহার করেছে বিজেপি। আর নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয় মনোভাবের জন্য ফেসবুকও NEWJ-কে ছাড় দিয়েছে।
জানা গিয়েছে, ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া তরফে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কিছু এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে করে ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজেপির প্রচার কোনভাবেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়। কংগ্রেসের প্রচার করা হচ্ছে বলে, ৬৮৭ টি পেজ ও অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা হয়েছে। কিন্তু বিজেপির হয়ে প্রচার করা কেবলমাত্র একটি পেজ ও ১৪ টি অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা হয়েছে। যা তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা সিলভার টাচ চালাত। ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ২২ মাস ধরে ১০টি নির্বাচনের সময় NEWJ ৭১৮ টি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালিয়েছে। যা ২৯০ মিলিয়ান গুন বেশি ভিউ পেয়েছে। সংস্থাটি বিজ্ঞাপনের জন্য ৫.২ মিলিয়ান টাকা খরচ করেছে। যার অধিকাংশই মুসলমান বিরোধী ও পাকিস্তান বিরোধী। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময় পাকিস্তান বিরোধী জাতীয়তাবাদী প্রচার হয়েছ। হিন্দুদের উত্তেজিত করতে বয়কট অ্যামাজন ট্রেন্ডেও কনটেন্ট তৈরি করেছে NWEJ। নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে বিজেপি সরকারের নীতি ও নেতাদের গুনগান করেছে তারা। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়তেও বিজেপির হয়ে ব্যাটিং করেছে সংস্থাটি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর আক্রমণ দেখিয়ে এখানে মিসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংস্থাটি উপাধ্যায় ভাই-বোন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তৈরি করে। ২০১৮-এর নভেম্বরে ৮৪ মিলিয়ান টাকার বিনিময়ে NWEJ- এর ৭৫ শতাংশ অংশীদারী কিনে নেই রিলায়েন্স গ্রুপ।
এই সামগ্রিক রাজনৈতক প্রচারে, বিজেপি কেন্দ্রীক প্রচারগুলোর ক্ষেত্রে অন্ধের ভূমিকা পালন করছে ভারতের নির্বাচন কমিশন ও ফেসবুক। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের আগে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোকে কমিশনের অনুমতি পেতে হয়, নির্বাচনের সময় সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের জন্য এই নিয়ম ২০১৩ সালে বাধ্যতামূলক করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না, ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রচারের ক্ষেত্রে কত খরচ হচ্ছে, প্রার্থীকে সেই তথ্য পরিসংখ্যান নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হয়। কিন্তু যখন কোন তৃতীয় ব্যক্তি, কোন দল বা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির হয়ে প্রচারে অর্থ খরচ করে; সেই খরচের পরিমানও নির্বাচন কমিশনের কাছে জানানো উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে বিজেপির হয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রচারের জলের মতো টাকা খরচ করেছে রিলায়েন্স, তার হিসেব কোথাও নথিভুক্ত করা হয়নি।
রিলায়েন্সের তরফে এখনও কোন প্রতিক্রিয়া মেলেনি। এই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে রিলায়েন্স গ্ৰুপের তরফে কোনরকম বিবৃতি এলে আমরা তা প্রকাশ করব।