প্রাচীন ভারতে কীভাবে প্রচলিত হয়েছিল রাখিবন্ধন? জেনে নিন ইতিহাস
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ‘তোমার হাতের রাখি খানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে।’
সম্প্রীতির উৎসব রাখিবন্ধন। আজকের দিনে বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখি বেঁধে দেন। তার সঙ্গে দিদি বা বোনেরা ভাই বা দাদার মঙ্গল কামনা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করেন। শ্রাবণ মাসের শুক্ল পক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে বাংলায় এই উৎসব পালিত হয়। ভারতে রাখি শুধু ভাই-বোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এখানে রাখি অর্থ সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন, সম্প্রীতির প্রতিশ্রুতি। কিন্তু জানেন কী আমাদের দেশে রাখি পূর্ণিমার শিকড় ছড়িয়ে ছিল মহাকাব্যে এবং লোককথাতেও।
জেনে নিন রাখিবন্ধনের প্রাচীন ইতিহাস
তিনি জানিয়েছেন, গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ যখন চিতোর আক্রমণ করেছিলেন তখন দিল্লির বাদশার কাছে সাহায্য চেয়েরাখি ও পত্র পাঠান বিধবা রানি। হুমায়ূন সেই রাখি গ্রহণ করেন। পরে তিনি চিতোরকে বাঁচাতে সেনা পাঠালেন, ততক্ষণে জওহর ব্রত করে প্রাণ দিয়েছেন রানি কর্ণাবতী। কিন্তু রক্ষাবন্ধনে দেওয়া কথা রাখতে বাহাদুর শাহকে হারিয়ে চিতোর উদ্ধার করেন হুমায়ূন। সিংহাসনে আসীন হন কর্ণাবতীর পুত্র।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির আরও জানান, মহাকাব্যেও রক্ষাবন্ধনের উল্লেখ রয়েছে। শোনা যায় শিশুপাল বধের সময় সুদর্শন চক্রে শ্রীকৃষ্ণের হাতের কনিষ্ঠা কেটে যায়। রক্ত ঝরতে দেখে ছুটি আসেন কৃষ্ণ-সখী কৃষ্ণা, দ্রৌপদী। দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে তাঁর হাতে বেঁধে দেন। এই যে কাপড় বেঁধে দিয়েছিলেন দ্রৌপদী, তা তৈরি হয়েছিল কাপাস তুলোর সুতো দিয়ে। মানে সেই সুতোর বন্ধন। সেই থেকেই শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। যখন ভরা রাজ সভায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে মত্ত ছিলেন, সেই সময় ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে শ্রীকৃষ্ণর। তারপর দ্রৌপদীর লজ্জানিবারণ করেছিলেন তিনি।
অন্য মতে প্রাচীনকালে উপাকর্ম বলে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। এই বিশেষ দিনে ব্রাহ্মণরা তাঁদের উপবীত পাল্টাতেন। সেই উপবীত অর্থ কিন্তু পবিত্র সুতোর বন্ধন। এইভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল লোকাচার বা কিংবদন্তী।
অর্বাচীন পুরাণ মতে শ্রাবণী পূর্ণিমা বা ঝুলন পূর্ণিমার দিন রাজা তাঁর পিতৃপূর্বের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। রাজা সেদিন যেখানে বসতেন, সেখানে উপস্থিত থাকতেন সব বর্ণের মানুষেরা। এমনকী সেদিন হাজির থাকতেন দেহপোজীবিনীরাও। ঐদিন উপাচার শুরুর আগে রাজ পুরোহিত রাজার হাতে বেঁধে দিতেন একটি সুতো, যার মাধ্যমে তাঁর শুভকামনা করা হত। তারপর সেখানে উপস্থিত সব মানুষের হাতেই সুতো বাঁধা হয়। সেটাও সমাজে রাজার আশ্রয়ে থাকা সকলের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি।
রাখি বন্ধন নিয়ে প্রচলিত কাহিনির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রবি ঠাকুরের রাখি উৎসব। যেখানে তিনি সৌভ্রাতৃত্বের ভাবনাকে বাংলার মানুষের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গের আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সকলকে সামিল করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিনচন্দ্র পাল ডাক দিয়েছিলেন ঐক্যবন্ধনের। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর, ৩০শে আশ্বিন সকলের হাতে রাখি পরিয়ে সম্প্রীতির দিন ঘোষিত হয়েছিল।
রাখি বন্ধন, রক্ষাবন্ধন কিংবা শ্রাবণী যে নামেই ডাকা হোক না কেন, যুগ যুগ ধরে এই আচার কিন্তু বন্ধন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথাই বলে এসেছে। ইতিহাস থেকে বর্তমান ভারতে সেই ঐতিহ্য রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।