Durga Puja 2025: কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দুর্গা পূজিতা হন রাজরাজেশ্বরী রূপে, জানেন পুজোর রীতি-রেওয়াজ?

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৬:০০: নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহাসমারোহে দুর্গাপুজো করতেন। তাঁর সময়তেই ধারে-ভারে ও আয়তনে-পরিসরে দুগ্গা পুজোর বহর বেড়েছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলনের নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। বঙ্গে দুর্গাপুজোকে সার্বজনীন করছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই। অবশ্য রাজ পরিবারে দুর্গাপুজো তাঁর জন্মের আগে থেকেই হয়ে আসছে। মহারাজা রুদ্র রায় ১৬৬৩ সালে, রাজপরিবারে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। সিরাজের পতনের পর অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের পর থেকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর রমরমা শুরু হয়েছিল। রায় পরিবারে মাতৃশক্তির আরাধনা চলে আসছে আজ দীর্ঘদিন, সূত্রপাত হয়েছিল অন্নপূর্ণা পুজোর মধ্য দিয়ে। তারপর একে একে দুর্গাপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটেছে।
রাজবাড়ির দুর্গার প্রচলিত নাম রাজরাজেশ্বরী। এখানে তিনি যুদ্ধের বেশে সজ্জিতা, বর্ম পরিহিতা। ঘোটকাকৃতি সিংহের উপর তিনি অধিষ্ঠান করেন। কী অদ্ভুত! ঘোটকমুখী সিংহ প্রধানত বৈষ্ণব বাড়ির প্রতিমার দেখা যায়, কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে তেমনই সিংহের দেখা মেলে। কিন্তু দেবী রণং দেহী, যোদ্ধার বেশে। আবার এ বাড়ির দুগ্গা পুজোয় এক সময় ছাগ বলিও হত। শাক্ত, বৈষ্ণব সব মিলে যাচ্ছে…আদপে নদীয়াই এমন এখানে যেমন চৈতন্যর ভক্তিবাদ আছে, তেমনই আগমবাগীশের কালীও আছেন। আবার শিবও। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব সব মিলেমিশে একাকার।
যাই হোক রাজরাজেশ্বরীতে ফিরি। প্রচলিত ডাকের সাজের চেয়ে দেবীর সাজ আলাদা। একে বলা হয় ‘বেদেনি ডাক’। আজও নিয়ম মেনে এখানে মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদে রাজরাজেশ্বরীর হোম জ্বালানো হয়। রাজবাড়ির দুর্গা দালানে দেবী রাজরাজেশ্বরীর ডান পাশে বিশালাকার হোমকুণ্ডে রাজবাড়ির সদস্যদের উপস্থিতিতে আগুন জ্বালানো হয়। ঘি, বেলকাঠ, মধু, কলা, বেলপাতা ইত্যাদি উপাচারে যজ্ঞ হয়। আগুন জ্বলে টানা নবমী পর্যন্ত। তারপর আগুন নেভানো হয় নবমী নিশিতে। গঙ্গা জল, মধু, ঘি, কলা, পানের আহুতি দিয়ে আগুন নেভানো হয়। আজও পুজোর জন্য গঙ্গা জল আনা হয় নবদ্বীপ থেকে।
রাজরাজেশ্বরী পাটে আসীন হন বোধনের সময়ে। ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়। নাটমন্দিরের পিছনে বোধনের ঘরে হয় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা। বেহারাদের কাঁধে চাপিয়ে দেবীকে রাজবাড়ির পঙ্খ অলঙ্কৃত দুর্গাদালানে অধিষ্ঠিত করা হয়। উল্টোরথের পরদিন পাটপুজোর মাধ্যমে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। ওই দিন থেকেই প্রতিমা নির্মাণের কাজ আরম্ভ হয়। চিরাচরিত দুর্গা প্রতিমার থেকে রাজরাজেশ্বরীর মূর্তি আলাদা। দেবী দুর্গার সামনের দু’টি হাতই বড়, পিছনের আটটি হাত আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালচিত্র থাকে দেবীর পিছনে, তার এক দিকে দশাবতার, অন্য দিকে দশমহাবিদ্যা আঁকা। মধ্যিখানে থাকেন পঞ্চানন শিব।
রাজবাড়ির পুজোর অন্যতম সেরা আকর্ষণ সন্ধীপুজো, আজও ওই সময়টাতে ভিড় করেন মানুষ। এক সময় কামান দেগে সন্ধিপুজো শুরু হত। এখন আর তা হয় না। ১০৮টি পদ্মফুলে এবং ১০৮টি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপে সন্ধীপুজো হয়। পশু বলি এখন বন্ধ, তবে বলিদানের রীতি আজও পালন করা হয়। আখ ও চালকুমড়োর বলি হয়। এছাড়াও শত্রুবলির রেওয়াজ রয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর পুরনো প্রথা মেনে বোধনের বেলতলায় কাঁচা মাটি দিয়ে শত্রুর প্রতীকী মূর্তি তৈরি করা হয়। রাজবাড়ির গৃহকর্তা তীর-ধনুক দিয়ে শত্রুবধ করেন, এই প্রথা শত্রুবলি নামে পরিচিত।
রাজবাড়ির পুজোর আরেক আকর্ষণ হল ভোগ। দেবীর ভোগে খিচুড়ি, ভাজা, ছ্যাঁচড়া, নানাবিধ তরকারি, চাটনি, সুজি, পায়েস ইত্যাদি থাকে। তিথি মিলিয়ে এখানে ভাজা নিবেদন করার রেওয়াজ রয়েছে। সপ্তমীতে সাত রকমের ভাজা হয়। অষ্টমীতে পোলাও, ছানার ডালনার সঙ্গে ভাত, আট রকম ভাজা, মিষ্টি, ক্ষীরসহ একাধিক পদ থাকে। নবমীতে দেওয়া হয় ন’রকম ভাজা, তিন রকম মাছ, ভাত, মিষ্টি। দশমীতে গলা ভাত, শিঙি মাছ, খই, ফল, দই, চিঁড়ে ভোগ দেওয়া হয়। শীতলভোগে থাকে লুচি, ভাজা, তরকারি ও সুজি।
দশমীর দিন যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান হয়। রাজ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ কিছু জিনিস দর্শন করতে হয়। আজকাল প্রতীকী দর্শনের মাধ্যমে রীতি বজায় রাখা হচ্ছে। সবৎস্য ধেনু, বৃষ, গজ, ঘোড়া, নৃপ, গণিকা, জ্বলন্ত বহ্নি, পতাকা, কাটা মাংস ইত্যাদি (প্রতীকী) কলাপাতার ওপর রাখা হয়, রাজপরিবারের সদস্যরা তাই-ই দেখেন। দেবীর নিরঞ্জনের প্রাককালে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও, আজকাল আর তা মানা হয় না। কারণ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন। দশমীর পুজোর পর নাটমন্দির থেকে বের করে রাজরাজেশ্বরীকে সাত পাক ঘুরিয়ে রাজবাড়ির পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।
দুর্গাপুজোর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলনের ইতিহাস। সাল নিয়ে মত, অমতের অন্ত নেই। কিন্তু গোদা বাংলায় বিষয়টা যা দাঁড়ায়, বলছি থুরি লিখছি। তবে হ্যাঁ, বলে রাখি সবটাই জনশ্রুতি। একদা মুর্শিদাবাদের কোনও এক নবাবের হাতে বন্দি হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেবার দুর্গাপুজোর সময় তিনি রাজবাড়িতে ছিলেন না, তখনই নাকি তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করার নির্দেশ পান।
বাংলার নবাব আলীবর্দি খাঁর রাজত্বকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাবের নজরানা দিতে অপারগ হন। নবাববাহিনী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায়। কিছু দিন পর কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পেয়ে নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছিলেন। সেই সময় নদীঘাটে তিনি বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে ব্যথিত হন। রাজরাজেশ্বরী মায়ের মুখ দেখা হল না তাঁর, দুঃখে কষ্টে ঘুমিয়ে পড়েন কৃষ্ণচন্দ্র, এমন সময় স্বপ্নে এক রক্তম্বুজা চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী দেবীমূর্তির দর্শন পান। কার্তিকের শুক্লা নবমীতে তাঁর পুজো করার আদেশ পেলেন কৃষ্ণচন্দ্র। আদেশ পেয়ে তিনি ছুটলেন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রর কাছে। তান্ত্রিকের বিধানে দেবীর এই রূপের পুজো শুরু হল। কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাস করতেন মা দুর্গাই আবার অন্য রূপে ফিরে এসেছেন। সেই কারণে, দুর্গার মতোই জগদ্ধাত্রী মূর্তিকেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে বলা হয় রাজরাজেশ্বরী। মনে করা হয়, ১৭৫২ থেকে ১৭৫৬-র মধ্যে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো হয়েছিল। কারণ আলীবর্দি ১৭৫৬-তে মারা যান। তবে কেউ কেউ বলে