‘পর্যটক দলের সর্দার’ অমিত শাহের সাতটি ভুয়ো অভিযোগ শুধরে দিলেন ডেরেক ও সুব্রত
শনিবার মেদিনীপুরের সভায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অমিত শাহ। বাংলার মানুষকে একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হয়নি বলে তোপ দেগেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর অভিযোগগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা বলে পাল্টা অভিযোগ করে রবিবার টুইট করলেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। একইসঙ্গে এদিন সাংবাদিক বৈঠক ডেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ভুল তথ্য শুধরে দিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এদিন একের পর এক অমিত শাহের সাতটি ‘অসত্য’ বক্তব্য তুলে ধরে ‘সঠিক তথ্য’ তুলে ধরেছেন তাঁরা।
এদিন টুইটে বিজেপি–কে ‘পর্যটক দল’ ও অমিত শাহকে সেই দলের ‘সর্দার’ বলে কটাক্ষ করে ডেরেক অভিযোগ করেছেন, একটি বক্তৃতায় সাতটি ভুয়ো তথ্য তুলে ধরে নিজের মান আরও নীচে নামিয়েছেন তিনি। মোট সাতটি ‘ফ্যাক্ট চেক’–এর প্রথমেই ডেরেক ও’ব্রায়েন ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অমিত শাহের অভিযোগের কথা।
শনিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অন্য দলের জন্য কংগ্রেস ছেড়েছিলেন আর আজ দলত্যাগের জন্য অন্যদের আক্রমণ করছেন।’ অমিত শাহয়ের এই কথা অসত্য বলে দাবি করে ডেরেক ও সুব্রত জানিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনওদিন দলবদল করেননি। তিনি ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস নামে একটি নতুন দল তৈরি করেছিলেন। এ ব্যাপারেই এদিন জানিয়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘দেশে প্রধানমন্ত্রীর পরই যাঁর স্থান তিনি যদি এ কথা বলেন তা হলে আমরা মর্মাহত হই।’
অমিত শাহয়ের আরও অভিযোগ, ‘বাংলার মানুষকে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।’ টুইটে ডেরেক ও সাংবাদিক বৈঠকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আসলে তা নয়, ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পর দু’বছর আগে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প বাংলায় শুরু হয়েছিল। ‘স্বাস্থ্যসাথী’র অধীনে ১.৪ কোটি পরিবার বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা পেয়েছে। বাড়ির মেয়েদের নামে দেওয়া এই ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডের মাধ্যমে আরও ভাল ভাল পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে।’
অমিত শাহ আরও বলেছেন যে কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘পিএম কিসান’ থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু বাস্তব হিসেবে তৃণমূলের দাবি, ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের আওতায় বাংলার কৃষকরা একর প্রতি বার্ষিক ৫ হাজার টাকা সহায়তা পান। কিন্তু ‘পিএম কিসান’–এ একর প্রতি মাত্র ১২১৪ টাকা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ‘শস্যবিমা’র ক্ষেত্রে কৃষকদের হয়ে সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কৃষকদের থেকে এক টাকাও নেওয়া হয়না। কিন্তু কেন্দ্রের ‘পিএমএফবিওয়াই’ প্রকল্পে প্রিমিয়ামের একাংশ নেওয়া হয় কৃষকদের থেকেই।
গতকাল অমিত শাহ সভা থেকে দাবি করেছেন, ‘দেড় বছরে ৩০০ বিজেপি কর্মী নিহত হয়েছেন।’ এর জবাবে এদিন সাংবাদিক বৈঠকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এর থেকে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না।’ তৃণমূলের দাবি, নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বহু বিজেপি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এমনকী আত্মহত্যার মৃত্যুকেও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে চালানো হচ্ছে এবং এই সংখ্যাতত্ত্বকে আরও ভুলভাবে মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে রাজনৈতিক প্রতদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের ১০২৭ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। একইসঙ্গে তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি–র ১১৬ জন বর্তমান লোকসভার সাংসদের বিরুদ্ধে অপারধমূলক রেকর্ড আছে।
বিজেপি তথা অমিত শাহের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদি বাংলার মানুষের জন্য খাদ্যশস্য পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তৃণমূলের কর্মীরা সেগুলো নিজেদের জন্য নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? তৃণমূলের উত্তর, বাংলার ‘খাদ্যসাথী’ কর্মসূচির আওতায় ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি মানুষ যাতে বিনামূল্যে রেশন পায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘ভারতের ইতিহাসে এটা একটা সর্বকালের রেকর্ড। ভারতের কোনও রাজ্যে এই জিনিস হয়নি।’
বিজেপি–র সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডাকে তাঁর বাংলা সফরে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি রাজ্য সরকার, এই বলে শনিবার রাজ্যের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন অমিত শাহ। কিন্তু এই অভিযোগ অস্বীকার করে ডেরেক ও সুব্রত জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার জে পি নড্ডার জন্য ‘জেড প্লাস’ সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। তবে অনেকগুলি গাড়ির কনভয় তাঁকে অনুসরণ করায় ওই ‘জেড প্লাস’ সুরক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়।
অমিত শাহের কথায়, ‘নরেন্দ্র মোদি বাংলার গরিব মানুষদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন।’ কিন্তু তৃণমূল এদিন তথ্য দিয়ে দাবি করেছে, একটা বাড়ি তৈরি করতে কেন্দ্র ৬০ শতাংশ ও রাজ্য সরকার ৪০ শতাংশ টাকা দেয়। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাজ্য সরকার ৩৩ লক্ষ ৮৭ হাজার বাড়ি নির্মাণ করেছে। যার জন্য ৩৯ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আর ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকল্পের অধীনে ৩৫৫০ কোটি টাকা খরচ করে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ‘সবার জন্য বাড়ি’ প্রকল্পে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ৪ লক্ষ ৩০ হাজার বাড়ি তৈরি করেছে রাজ্য। সুব্রত মুখোপাধ্যায় এদিন এইসব তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘আশা করি, অমিত শাহ তাঁর পরবর্তী সভায় নিজের ভুল শুধরে মানুষের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরবেন।’