মাতৃবিয়োগ সত্ত্বেও কাছা নিয়েই প্রচারে তাপস
শোক-যন্ত্রণা সামলে ফের বরানগরের রাস্তায় নেমেছেন তাপসবাবু।

‘ভালো থেকো বাবা, জিতে এসো।’ নুয়ে পড়া কোমর নিয়েই হাতটা ছুঁতে চাইলেন এক বৃদ্ধা। ততক্ষণে আশীর্বাদের জন্য মাথা নামিয়ে দিয়েছেন বরানগর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তাপস রায়। চারিদিকে ভিড়, স্লোগান। কুশল বিনিময় করে আবার সামনের দিকে হাঁটা। পিছনে মঙ্গল কামনায় বিড়বিড় করে চলেছেন বৃদ্ধা। শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলেন তাপসবাবু।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরদিনই মাকে হারিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। নির্বাচনী যুদ্ধের উত্তাপ বদলে গিয়েছিল শোকে। দু’দিন বন্ধ প্রচারও। কিন্তু এবারে যে বাংলা ও বাঙালির সত্তাকে বাঁচানোর লড়াই। তাই শোক-যন্ত্রণা সামলে ফের বরানগরের রাস্তায় নেমেছেন তাপসবাবু। এবং কাছা নিয়েই। তার সঙ্গে গায়ে একটি সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি।
শনিবার সকাল পৌনে ন’টা। বনহুগলির মাতা মনমোহিনী নগরে দু’বারের বিধায়ককে এমন শোকের পোশাকে দেখে কিছুটা চমকেই ওঠেন বাসিন্দারা। সেখান থেকে নবীনচন্দ্র দাস রোড, সরকার পাড়া, অনন্যা, টবিন রোড, বরানগর স্টেট জেনারেল হাসপাতাল—বাড়ি বাড়ি প্রচারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্থানীয়দের চোখে ছিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিই। বারবার নেতা-কর্মীদের কাছে তাঁরা জানতে চেয়েছেন, ‘কী হয়েছে দাদার?’ মাতৃবিয়োগের কথা শুনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন সকলেই।
মাতা মনমোহিনী স্কুলের সামনে থেকে এদিন প্রচার শুরু করেন তাপসবাবু। সামনে অটো-টোটোয় মাইক লাগানো। পিছনে রণপা পরে দু’জন, ফ্লেক্স হাতে মহিলারা এবং ব্যান্ড পার্টি। খানিক ব্যবধান রেখে তৃণমূল প্রার্থী। প্রতিটি বাড়ির সামনে গিয়ে করজোড় করে সৌজন্য বিনিময় করেছেন। রাস্তায় নেতাজি এবং বিদ্যাসাগর মূর্তিতে মাল্যদানও করতেও দেখা গিয়েছে। প্রায় শ’দেড়েকের ভিড় প্রথম থেকেই ‘খেলা হবে’ স্লোগানে গলা মিলিয়েছে। মাঝে মধ্যেই মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে অলিগলিতে ঢুকে পড়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। নিরাশ করেননি কাউকেই। ধৈর্য্য ধরে অনুযোগও শুনেছেন বাসিন্দাদের। আশ্বাস দিয়েছেন ভোটের পরে কাজ হওয়ার।
তাপসবাবুই বলছিলেন, ‘আমার প্রচার ৩৬৫ দিনই। রাজনীতি, অরাজনীতি, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ক্লাব, পুজো হেন কোনও অনুষ্ঠান নেই, যেখানে আমন্ত্রণ পাই না। আর পেলেই হাজির হই।’ ভোটের আগে প্রচারে তিনি জোর দিচ্ছেন টিম মমতার কাজে। ব্যাখ্যা দিলেন, কাউন্সিলার, বিধায়ক, সংসদ সদস্য সকলে মিলে গত ১০ বছরে টিম মমতা যে কাজ করেছে, তা বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস আমলে হয়নি। সমস্যা হয়তো এখনও আছে। তারও সুরাহা করব। এখানে জ্যোতি বসু ছ’বারের টানা বিধায়ক ছিলেন। তারপর সিপিআই, আরএসপি। বরানগরের হাল অনেকটাই বদলে দিতে পারতেন তাঁরা। কেন করেননি, জানি না!
অঙ্কের বিচারে বরানগর কেন্দ্রে এগিয়েই রয়েছে রাজ্যের শাসকদল। ২০১৬ বিধানসভা ভোটে আরএসপি প্রার্থী সুকুমার ঘোষকে প্রায় ১৬ হাজার ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন তাপসবাবু। গত লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে এই বিধানসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে গেরুয়া শিবির। ভোটের ব্যবধান ছিল প্রায় ১৫ হাজার। তারপর বিজেপি এখানে সক্রিয়তা বাড়িয়েছে। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে এখানে অভিনেত্রী পার্নো মিত্রকে প্রার্থী করেছে তারা। অন্যদিকে, সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে কংগ্রেসের প্রার্থী অমল মুখোপাধ্যায়। দু’জনের প্রচারেই ভিড় তৃণমূল প্রার্থীর তুলনায় বেশ কম।
তাপসবাবুর মতো দাপুটে নেতা কিন্তু প্রতিপক্ষকে হাল্কাভাবে নিতে রাজি নন। আত্মসন্তুষ্টি নয়, পরিশ্রমই তাঁর কাছে শেষ কথা। তাই প্রখর রোদে ঘণ্টাতিনেকের প্রচারে ঘামতে ঘামতেও হাঁটায় একটুও বিরতি দিলেন না। আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, সেই ১৫ বছর ৯ মাস বয়স থেকে রাজনীতি করছি। আমি আপাদমস্তক রাজনৈতিক কর্মী। আশা করব, সেটা মানুষের কাছে গুরুত্ব পাবে। পরিবারে কেউ রাজনীতিতে ছিলেন না। মায়ের উৎসাহ ছিল তাপসবাবুর পাথেয়। বলছিলেন, সে সময় সিপিএমের আক্রমণ প্রতিহত করতে মহিলাদের নিয়ে মিছিল-অবস্থান করতেন মা। আজ এক কাপালিক শক্তি বঙ্গ-সত্তার উপর আঘাত হানছে। এখন শোক নিয়ে বসে থাকলে মায়ের আত্মা শান্তি পেত না।