বঙ্গদেশ ও বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাসের অনন্য এক উপাখ্যান

প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস আর বৌদ্ধধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একটির কথা বলতেই আরেকটি উঠে আসে।

May 16, 2022 | 3 min read
Published by: Drishti Bhongi
ছবি সৌজন্যে: East Mojo

প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস আর বৌদ্ধধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একটির কথা বলতেই আরেকটি উঠে আসে। পাশাপাশি বঙ্গের ইতিহাস এবং বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-জীবনধারার ক্রমবিকাশে বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ছবি সৌজন্যে: Times Food

বঙ্গদেশে ঠিক কোন সময়ে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য এখনও মেলেনি। তবে অনুমান করা হয় গৌতম বুদ্ধের সময়কাল হতেই বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন হয়েছিল। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. নীহার রঞ্জন রায়দের মতে, অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাংলায় কোন কোন স্থানে বিস্তার লাভ করেছিল। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, মগধ ও বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এত কাছাকাছি যে, বুদ্ধের জীবিতকালেই মগধ হতে বৌদ্ধধর্মের ঢেউ এসে বাংলাকে প্লাবিত করা মোটেই অসম্ভব নয়। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে, বুদ্ধের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশে প্রচার লাভ করেছিল। মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সমগ্র বঙ্গদেশের প্রধান ধর্ম পরিণত হয়েছিল।

ছবি সৌজন্যে: Jagran English

তবে তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। প্রাকগুপ্তযুগের মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি অস্থিখন্ড। খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী অক্ষরের লেখাটির ঐতিহাসিক অনুসন্ধান অনুসারে, প্রাকগুপ্তযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পন্ডিত শীলভদ্র এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ছিলেন বঙ্গদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।

ছবি সৌজন্যে: Time and Date

চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এরপরেই শশাঙ্ক স্বল্প সময়ের জন্য এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশ বছরের বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা চলে, ইতিহাসে যাকে মাৎস্যন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়। সেই সময় দমনের জন্য বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে গোপাল নামক এক সামন্তরাজাকে বাংলার রাজা হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হন। পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করেন। ১২০৫-১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান। সেনবংশের শাসনামলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

ছবি সৌজন্যে: Times of India

পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন রাজবংশের অভ্যূত্থান হয়। সেন আমলে বৌদ্ধ, বৌদ্ধমঠে ধ্বংসলীলার সূত্রপাঠ হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তুর্কী বীরেরা ওদন্তপুরী, নালন্দা, বিক্রমশীলা, বঙ্গদেশ প্রভৃতি জয় করার পর সমস্ত মূর্তি ও অগণিত আদর্শ শিল্পকলা ধ্বংস, শত শত ভিক্ষুকে শিরচ্ছেদ করে বখতিয়ারের নেতৃত্বে, গ্রন্থসমূহ ভস্মসাৎ করা হয় এবং ধ্বংস করা হয় শতাধিক কলা-কৌশলের নমুনা।

ছবি সৌজন্যে: East Mojo

যুগে যুগে মর্মান্তিক বৌদ্ধ নির্যাতন ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি সমূলে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধদের রাজকীয় ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। এ কারণে দেখা যায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধ বিহারের সংলগ্ন অঞ্চলে বড় বড় মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে। সেসময় কিছুসংখ্যক বৌদ্ধ নেপাল ও তিব্বতে পালিয়ে যান। মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বৈশালীর বর্জি বংশীয় এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র বহুসংখ্যক অনুচরবৃন্দসহ মগধ সাম্রাজ্য হতে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আসাম, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন।

ছবি সৌজন্যে: Aaj Ki Khabar

বঙ্গদেশের অতীত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বৌদ্ধধর্মের যুগ। উত্তর ও মধ্য ভারতে বৌদ্ধ নিধনের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সেখান থেকে অবিভক্ত বাংলায় এসে পড়েন। এভাবেই এই বাংলায় সূচনা হয় বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগের। প্রায় হাজার বছর অবিভক্ত বঙ্গদেশ ছিল সারা পৃথিবীর বৌদ্ধধর্মের পুণ্যতীর্থ। ময়নামতী, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় আজও সেই ইতিহাস ধারণ করে রয়েছে। বাংলায় বৌদ্ধ, বৌদ্ধধর্মের অবদান শীর্ষস্থানীয়। বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য; যা বাংলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

ভিডিও

আরও পড়ুন

Decorative Ring
Maa Ashchen