ভারতের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানকে ‘C’ গ্রেড দিল IMF, অস্বস্তিতে মোদী সরকার
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি, ১৮:১৫: ভারতের জিডিপি ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)। সংস্থার বার্ষিক মূল্যায়নে ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস ডেটাকে দেওয়া হয়েছে ‘C’ গ্রেড, যা চারটি গ্রেডের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অর্থাৎ, এই তথ্যগুলিতে মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তা যথেষ্ট নয়। ঠিক জিডিপি-র (GDP) দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তথ্য প্রকাশের আগে এই মূল্যায়ন নয়াদিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক ‘Article IV’ রিপোর্টে ভারতের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের (Economic Statistics of India) মান নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিল, যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সেই সমালোচনা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়নেই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে সমস্যাগুলি উপেক্ষা করা যায় না।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের জিডিপি (GDP) ও সিপিআই (CPI) হিসেব করতে এখনও ২০১১-১২ সালের বেস ইয়ার (base year) ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বর্তমান ব্যয় অভ্যাস, উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তন কিংবা মানুষের খরচের ধারা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আরও একটি বড় ঘাটতি হল প্রডিউসার প্রাইস ইনডেক্সের (producer price index) অভাব। এর ফলে জিডিপি গণনায় পাইকারি মূল্য সূচককে ডিফ্লেটর হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা বাস্তব উৎপাদন খরচের যথাযথ ছবি তুলে ধরে না।
এছাড়া উৎপাদন ও ব্যয় পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গরমিল রয়েছে বলে আইএমএফ (IMF) জানিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে ব্যয়ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহে ঘাটতি রয়েছে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কভারেজও দুর্বল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল মৌসুমি সমন্বয়ের অভাব। ভারতের ত্রৈমাসিক জিডিপি তথ্য এখনও সিজনালি অ্যাডজাস্টেড নয়, যা উন্নত দেশগুলিতে বাধ্যতামূলক। আইএমএফের মতে, আধুনিক পরিসংখ্যান পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রগুলিতে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
আইএমএফের মতে ভারতের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান আরও নির্ভুল করতে হলে কিছু অতিরিক্ত তথ্যের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিস্তারিত বিভাজন জরুরি বলে তারা মনে করছে। একইভাবে ত্রৈমাসিক উৎপাদন ও ব্যয়ভিত্তিক তথ্যের আরও সূক্ষ্ম ভাগ করলে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র স্পষ্টভাবে ধরা সম্ভব হবে।
সামগ্রিকভাবে ভারতের ডেটার মানকে আইএমএফ ‘B’ গ্রেড দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারি অর্থ পরিসংখ্যান, বৈদেশিক খাত, মনিটারি ও ফিনান্সিয়াল ডেটা সব ক্ষেত্রেই তথ্য গ্রহণযোগ্য হলেও কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। তবে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস সেক্টরে আগের মতোই এবারও ‘C’ গ্রেড দেওয়া হয়েছে। সংস্থার মতে, দুর্বলতাগুলি মূলত অপরিবর্তিত রয়েছে, যদিও নতুন বেস ইয়ার চালু করা এবং আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের পরিকল্পনা এগোচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতির তথ্যের ক্ষেত্রেও ভারতের উপভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) পেয়েছে ‘B’ গ্রেড। এর প্রধান কারণ, এখনও ২০১১-১২ সালের বেস ইয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সময়ের পণ্যের ঝুড়ি ও ওজন পদ্ধতি বর্তমান ব্যয় অভ্যাসের সঙ্গে আর খাপ খায় না। যদিও তথ্য প্রকাশ সময়মতো হয়-প্রতি মাসে একবার এবং মাত্র এক মাসের ল্যাগ থাকে, তবুও পুরনো পদ্ধতির কারণে মান কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ভারতের মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থার নতুন শ্রেণিবিন্যাস করেছে। আগে যেখানে এই ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল বলা হয়েছিল, এবার সেটিকে তারা বর্ণনা করেছে এক ধরনের “হামাগুড়ি দিয়ে চলা” বা crawl-like arrangement হিসেবে। অর্থাৎ গত ছ’মাস বা তারও বেশি সময় ধরে টাকার বিনিময় হার মাত্র ২ শতাংশের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আটকে থেকেছে। ফলে এটি আর ভাসমান বিনিময় হার হিসেবে গণ্য হচ্ছে না।
এই পরিবর্তনের পেছনে মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রার সময়ে টাকার ওঠানামার ধারা। আইএমএফের মতে, রিজার্ভ খরচ না করে আরও বেশি ফ্লেক্সিবিলিটি দেওয়া উচিত। ২১ নভেম্বর ডলারের তুলনায় টাকার দাম নেমে দাঁড়ায় ৮৯.৪৯-এ। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি ভারতের রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার হবে ৬.৬ শতাংশ এবং আগামী বছরে তা কমে দাঁড়াবে ৬.২ শতাংশে। সাম্প্রতিক কর সংস্কার ও নতুন বাণিজ্য চুক্তি বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, তবে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি অর্থনীতিকে বিপন্ন করতে পারে। খাদ্য সরবরাহে সমস্যা দেখা দিলে মুদ্রাস্ফীতি আবারও চাপ বাড়াতে পারে।
আইএমএফ আরও জানিয়েছে, বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কম থাকায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার কমানোর সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ২০২৬-২৭ অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।