দেশ বিভাগে ফিরে যান

কুড়ি দিন জেগে আছে শাহিন বাগ

January 5, 2020 | 3 min read

ছবি সৌজন্যেঃ Shemin Joy

এ যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন!‌ তা-‌ও সত্যাগ্রহের পথে। টানা বিশ দিনের অনশনে দুর্বল, অক্ষম শরীর নিয়ে কোনও মতে উঠে দাঁড়ালেন জইনুল আবদিন। বাঁ-‌হাতের কব্জিতে বিঁধে রয়েছে স্যালাইনের সুচ। তাঁর মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরলেন মহম্মদ আফতাব। আবদিন জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন। নমাজ-‌বিরতির পর আবার শুরু হল ‘‌শান্তিপূর্ণ অবস্থান’‌। শুক্রবার দুপুর। দিল্লির শাহিন বাগ।

মঞ্চের সামনে যতদূর চোখ যায় অবালবৃদ্ধবনিতার মুখ। শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবাদী মুখ। গভীর রাতে হাড়হিম করা ঠান্ডাতেও মঞ্চ না-ছাড়ার অঙ্গীকার জানান দিচ্ছে নব্বই ছুঁইছু্ঁই আসিমা বেগমের বগলে চাপা কম্বল। ওই দূর থেকে একরত্তি মেয়ের হাত ধরে দৌড়ে আসছেন বোরখায় মোড়া নাজমা। ১৮ দিনের সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে ততক্ষণে মঞ্চের সামনে পৌঁছে গেছেন সড়কের ওপারের ঝুপড়িবাসী সোনম বাল্মিকী। সঙ্গে আরও অনেকে। ওঁরা সব্বাই আসছেন স্বেচ্ছায়।

ছবি সৌজন্যেঃ Burhaan Kinu

কয়েকটা আধ-ছেঁড়া পলিথিনের তলায় বসে দিনরাত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-‌র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। গৃহস্থলির কাজকর্ম, নাওয়া-‌খাওয়া ইত্যাদি ফেলে তাও লোক আসছেন? সামনের এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইতেই পিছন থেকে আওয়াজ এল— ‘ভেবে দেখেছেন, ‌মুসলিম মহিলারা পর্দার আড়ালে থাকেন। সচরাচর ঘরের বাইরে বের হন না। এ তো সকলেই জানেন। তাহলে আজ নানা বয়সের এতজন মহিলা রাস্তার ওপর জড়ো হয়েছেন কেন?‌’ পেশাদার সাংবাদিক আন্দাজ করেই প্রশ্নটা করলেন এক বৃদ্ধা। সহস্র বলিরেখার আড়ালে চকচক করছিল তাঁর চোখ দুটো। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কোমর আপ্রাণ চেষ্টায় সোজা করে নিজেই বললেন, ‘‌শাহিন বাগ জেগেছে। এবার সমগ্র ভারত জাগবে।’‌

ক্যা বা এনআরসি কিছুই বোঝে না বছর আটেকের রুকসানা। ক্লাস থ্রি-‌র ছাত্রী। বড়দের সঙ্গে রাত জাগছে সে-‌ও। স্কুল যাওয়া-‌আসার ফাঁকে বাবা-‌মায়ের সঙ্গে আন্দোলন মঞ্চের সামনে স্লোগান তুলছে, ‘‌হম হক সে লেঙ্গে আজাদি/‌ হম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি’‌। রোজ বাড়ছে আন্দোলনের চেহারা। পাছে আরও বেশি লোক যোগ দেয়, দিল্লি-‌নয়ডা সংযোগ রক্ষাকারী ১৩-‌এ সড়ক তাই বন্ধ রেখেছে পুলিশ। আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে পুলিশের গাড়ি। কিন্তু, মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছয়নি তারা।

ছবি সৌজন্যেঃ Sukrita Baruah

বছর ছাব্বিশের মহম্মদ রমজান ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে কয়েকমাস আগেই বহুজাতিক কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে ছুটি নিয়ে এখানেই রয়েছেন। পেশায় আইনজীবী সাদাত হোসেন কোট-‌টাই পরেই একটি বড়সড় প্যাকেট নিয়ে হাজির। পানীয় জল ও বিস্কুটের প্যাকেট এনেছেন আন্দোলনকারীদের জন্য। সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধা নুরজাহান রুটি, তরকারি নিয়ে হাজির। সেই রুটিতে ভাগ বসাচ্ছেন সোনম, পুনমরা। সাদাতের কথায়, ‘‌২০১২-‌র ডিসেম্বরে নির্ভয়া-‌কাণ্ডের পর এমন স্বতঃপ্রণোদিত প্রতিবাদ আর দেখেনি রাজধানীর রাজপথ। সাধ্যমতো যেটুকু পারি, তাই করছি।’‌

বছর বারোর ইমানুল ইসলামের হাতে পোস্টার। তাতে লেখা, ‘‌মিলজুল কর হাম ইদ-‌হোলি-‌দিওয়ালি মানায়েঙ্গে/‌ মোদিজি যব যায়েঙ্গে, তো অচ্ছে দিন ভি আয়েঙ্গে’‌। বিকেল থেকে সন্ধ্যা তারপর রাত। কয়েকশো-‌র জমায়েত নিমেষেই ১০ হাজারে পৌঁছল। মঞ্চের বক্তারা সিএএ এবং এনআরসি-‌র বাইরে বেরোচ্ছেন না।

ছবি সৌজন্যেঃ Dailyhunt

ক্যা এবং এনআরসি প্রত্যাহারের আন্দোলনে যোগ দিতে গত ১৫ ডিসেম্বর জামিয়ার মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা রয়েছিলেন শাহিন বাগের রুকসানা, কওসর, ফতিমা, নওসাদ ও জইনুলের মতো জনা পঞ্চাশেক মানুষ। তাঁদের যেতে দেয়নি পুলিশ। ফিরে এসে সেই রাতেই শাহিন বাগে সড়কের ওপর বসে পড়েছিলেন তাঁরা। সেই শুরু। এখন নড়বড়ে ছোট্ট মঞ্চে শুয়ে আছেন জইনুল। তিনি অনশন করছেন। প্রতিদিন নিয়ম করে আরও ৫ জন মহিলা রিলে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে এসেছিলেন পাপ্পু যাদব, কপিল মিশ্র, ইমরান প্রতাপগড়ি, উমর খালিদের মতো অনেকেই।রাজনীতি থেকে বহু দূরে ‘‌সংবিধান রক্ষার লড়াই’‌ চালিয়ে যাচ্ছে একা শাহিনবাগ। রাজনীতি নেই। নেই কোনও সংগঠন। বিশেষ কারও উদ্যোগ নেই। আছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যা দিন-‌রাত বেড়ে চলেছে আড়ে-‌বহরে।‌

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#CAA, #NRC Protest, #Shaheenbag

আরো দেখুন