লর্ড কার্জন, রাজ্যপাল এবং ঐতিহাসিক ভুল
১৯০৫ সালে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ করার সেই দুরভিসন্ধি এবং চুক্তি-পরবর্তী প্রবল প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে ছয় বছর পর চুক্তি রদের সামগ্রিক ইতিহাসটি শ্রীধনখড়ের অজ্ঞাত থাকতে পারে, কিন্তু বাঙালি তা ভুলে যায় নি।
বঙ্গভঙ্গের চুক্তি যে টেবিলে স্বাক্ষর করা হয়েছিল, মাননীয় রাজ্যপাল তাকে ‘আইকনিক’ আখ্যা দিয়েছেন। রাজ্যবাসীকে ইংরাজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাবার সময় তিনি হঠাৎ ‘প্রবাদপ্রতিম টেবিল’-এর প্রসঙ্গ কেন টানলেন, বোঝা মুসকীল। তবে তিনি যে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস বিন্দুমাত্র না জেনে এবং জানবার চেষ্টা না করেই মন্তব্যটি করেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ১৯০৫ সালে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ করবার সেই দুরভিসন্ধি এবং চুক্তি-পরবর্তী প্রবল প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে ছয় বৎসর পর চুক্তি রদের সামগ্রিক ইতিহাসটি শ্রীধনখড়ের অজ্ঞাত থাকতে পারে, কিন্তু বাঙালি তা ভুলে যায় নি। ফলে, রাজ্যপালের টুইট ঘিরে নেটদুনিয়ায় প্রবল আলোড়ন এবং সম্ভবত সেই ধাক্কাতেই টুইট-প্রত্যাহার।
তবে, প্রসঙ্গ এখানে শ্রীযুক্ত ধনখড় নয়। প্রসঙ্গ, বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে গেরুয়া কাচের মধ্য দিয়ে দেখবার এবং দেখাবার উগ্র বিজেপি-সুলভ বাসনা। যাঁদের এত দিন পর্যন্ত দেশবাসী বিশ্বাসঘাতক বলে জেনেছিল, বিজেপি তাঁদেরই এখন দেশনায়কের সম্মান প্রদানে ব্যস্ত। এবং দেশ গড়িবার কারিগর হিসাবে জনমানসে যাঁরা এত কাল চিত্রিত হয়ে আছেন, তাঁদের খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত করতে উদ্গ্রীব। নাথুরাম গডসের মন্দির নির্মাণ, তাঁকে দেশভক্ত বলা, ব্রিটিশদের সঙ্গে আপসে ইচ্ছুক সাভারকরকে মহিমান্বিত করে তোলার মধ্যে এই গৈরিকীকরণের ছাপ স্পষ্ট। সম্প্রতি তারা যেমন ব্যস্ত ১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক দেশভাগ হতে কাশ্মীর সমস্যা পর্যন্ত যাবতীয় দায় কংগ্রস, তথা নেহরুর উপর চাপিয়ে দিতে।
অমিত শাহ লোকসভায় বলেছেন, ধর্মভিত্তিক দেশভাগ তাঁরা করেন নি, এটা কংগ্রেসের কীর্তি। ইতিপূর্বে বিজেপি নেতারাও প্রায় তাঁরই সুরে বলেছেন, নেহরু চেয়েছিলেন বলেই ভারত ১৯৪৭ সালে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। যা বলেন নি বা বলতে চান নি তা হল, নেহরু ধর্মভিত্তিক দেশভাগে আদৌ সম্মত ছিলেন না। তাঁকে এই কাজে রাজি করবার ভারটি নিয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই পটেল, গুজরাতের সর্দার সরোবর বাঁধের উপর যাঁর সুবিশাল মূর্তিটির উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সুতরাং প্রকৃত ইতিহাসকে যাঁরা হামেশাই নিজের প্রয়োজনে বিকৃত করে থাকেন, তাঁরা যে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস এবং বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভুলে যেতে চাইবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
শ্রীধনখড়ও যে সেই পথেই হেঁটেছিলেন, তা বলা মুশকিল। সম্ভবত তিনি বাংলার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু না-জানার মতোই জানতে না চাওয়ার প্রবণতাটিও ভারতীয় সমাজের একাংশের বৈশিষ্ট্য। প্রথমটিকে যদিও বা মার্জনা করা যায়, দ্বিতীয়টি অক্ষমণীয়। বিশেষত যে রাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে তিনি নিযুক্ত হয়েছেন, সেই রাজ্যের ইতিহাস জেনে নেওয়া কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তা নিছক ইতিহাস জানবার লক্ষ্যে নয়, রাজ্যবাসীর প্রতি সম্মানার্থেই রাজ্যের অতীতকে জানা প্রয়োজন। তা না করে এমন এক উত্তপ্ত সময়ে– কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাংলায় এনআরসি হবেই বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন— তখন রাজ্যপালের এই ‘না জানবার ইচ্ছা’ চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন।