শীতে সাবধান – নিরাপদ থাকুন জীবাণু থেকে
শীতকাল এসেছে মানেই আকাশে বাতাসে ছুটির গন্ধ। সোয়েটার, জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে সারাদিন দাপিয়ে বেড়ানো। সঙ্গে নিজের মন মতো খাওয়া। রোগের চিন্তা নেই। কারণ প্রচণ্ড শীতে নাকি রোগ জীবাণুর দাপট কমে যায়! এখানে বলি, কারও খাওয়া-দাওয়া, ঘোরা-ফেরাতে কোনও আপত্তি নেই। তবে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়লে রোগ জীবাণুর প্রভাব কমে যায়— এমন ধারণা কিন্তু একদমই ঠিক নয়। বরং এর উল্টোটাই সত্যি।
অর্থাৎ শীতে বেশ কিছু ভাইরাসের দাপট সারা বছরের তুলনায় বেড়ে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— রাইনো ভাইরাস, ফ্লু ভাইরাস, নরো ভাইরাস ইত্যাদি। এর মধ্যে রাইনো ভাইরাস এবং ফ্লু ভাইরাস ঠান্ডা লাগার জন্য দায়ী থাকে। এক্ষেত্রে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে জল গড়ানো, গলা ব্যথা, কাশি, কফ ওঠা, মাথা ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। অন্যদিকে নরো ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বমি হয়।
ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কথা বলতে গেলেও হতাশ হওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। কারণ ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের দাপটও গোটা বছরই সমান থাকে। তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে এদের সরাসরি কোনও যোগসূত্র নেই।
তবে কি শীতে কোনও রোগই কমে না?
নিশ্চয়ই কমে। শীতে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগগুলির আধিপত্য অনেকটাই কম দেখা যায়। তবে এর পিছনে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব কমে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং রোগগুলির বাহকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে যায় বলে অসুখগুলি দেখা যায় না। আসলে ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি তাপমাত্রাই হল মশার বংশবিস্তারের পক্ষে আদর্শ। কিন্তু তাপমাত্রা অনেকটা কমে গেলে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারে না। ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকটাই কমে যায়।
শীতে কারা সাবধান?
বাচ্চা এবং বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম থাকে। তাই এই নির্দিষ্ট বয়সসীমার অধীনে থাকা মানুষের শীতের রোগগুলিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই বেশি। এমনকী এই বয়সের রোগীদের সাধারণ ঠান্ডা লাগার সমস্যাও জটিল আকার নিয়ে নিতে পারে।
হঠাৎ করে খুব ঠান্ডা হাওয়া লাগলে অ্যাজমা রোগীদের অ্যাজমা অ্যাটাক হতে পারে। তাই শীতকালে অ্যাজমা রোগীদের খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
এছাড়া হার্টের অসুখে আক্রান্ত, ডায়াবেটিস রয়েছে বা অন্য কোনও জটিল রোগ থাকলেও এই সমস্যাগুলিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
শীতের রোগের চিকিৎসা
সাধারণত এই ধরনের রোগগুলির তেমন কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। ২ থেকে ৩ দিন বাদে এই সমস্যাগুলি আপনা থেকেই কমে যায়। এক্ষেত্রে গলা ব্যথা থাকলে গরম জলে নুন ফেলে বা শুধুমাত্র গরম জলে গার্গেল করা দরকার। নাক বন্ধ, কাশি ইত্যাদি বিভিন্ন ঠান্ডা লাগার উপসর্গের জন্য গরম জলের ভাপ নেওয়া যেতে পারে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটেমল ট্যাবলেটও খাওয়া যায়। সাধারণত এই কয়েকটি বিষয় মেনে চললেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
তবে ৩ দিনের বেশি জ্বর রয়েছে, কফের রং হলুদ বা সবুজ হয়ে গিয়েছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি লক্ষণে অবশ্য চিকিৎসকের কাছে আসতেই হবে। কারণ এক্ষেত্রে রোগীর ভাইরাল ইনফেকশনের পাশাপাশি সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনও থাকতে পারে। এই ধরনের সমস্যার সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে পরিস্থিতি জটিল দিকে মোড় নিতে পারে। তাই এমন লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে আসা চাই। চিকিৎসক রোগীর লক্ষণ দেখে প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধ দিয়ে থাকেন।
এছাড়া বাচ্চা, বয়স্ক মানুষ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি রোগে আক্রান্তদের অবশ্য প্রথম থেকেই সচেতন হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
এখানে বলা প্রয়োজন, অনেক ব্যক্তিই ঠান্ডা লাগলেই ওষুধের দোকানে বলে বিভিন্ন ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন। বিশেষত, শীত আসলেই ওষুধের দোকানে বলে কাশির সিরাপ এবং অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কাশির ওষুধ খেলে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। আর অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া নিয়ে তো আলাদা করে সচেতন হতেই হবে। সারা পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট বেড়ে চলেছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে নিজের এবং সমাজের ক্ষতি করার কোনও মানে হয় না।
রোগ প্রতিরোধ
জীবাণুর থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই ভালো হয়। এই ধরনের ভাইরাসগুলি মূলত হাত থেকে মুখ, নাক, চোখ হয়ে শরীরে প্রবশে করে। তাই হাত পরিষ্কার রাখা ছাড়া রোগ প্রতিরোধের উপায় নেই। নিয়মিত সময়ান্তরে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলেই সমস্যা মিটতে পারে। বিশেষত, বাচ্চাদের ধরার আগে হাত ধুয়ে নিতেই হবে। এছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পারলেও রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
অন্যদিকে কোনও ব্যক্তির ঠান্ডা লাগলে অবশ্যই তাঁকে সচেতন হয়ে রোগ ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। মুখে রুমাল চেপেই হাঁচতে, কাশতে হবে। ঠান্ডা লাগা অবস্থায় বাচ্চাদের কাছে না যাওয়াই ভালো।
এছাড়া বাচ্চা, বয়স্ক, অ্যাজমা রোগী, ডায়াবেটিক রোগী, হার্টের সমস্যায় ভোগা রোগী সহ বেশকিছু জটিল সমস্যায় আক্রান্ত মানুষকে শীতের শুরুর সময়ই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই ভ্যাকসিনটি নেওয়া থাকলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসজনিত রোগগুলিকে এড়ানো যায়।