লক্ষ্মীর মানসপুত্র – প্রবাসী বঙ্গসন্তান
পঞ্চাশের দশকের কথা। তখন তিনি ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র ছাত্র। অনেক দাম দিয়ে একটা মিউজিক সিস্টেম কিনেছিলেন। কিন্তু তাতে গান শুনে মন ভরল না। অথচ কোনও অডিটোরিয়ামে গান শুনতে গেলে তো এমন হয় না!
কারণ খুঁজতে শুরু করলেন এক প্রবাসী বঙ্গসন্তান।দেখলেন, প্রেক্ষাগৃহে গায়কের গলার ৮০ শতাংশ সরাসরি শ্রোতার কানে আসে না। আসে দেওয়ালে ছাদে ধাক্কা খেয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর পদার্থবিদ্যার এই মূল সূত্রকে কাজে লাগিয়ে নিজেই মিউজিক সিস্টেম তৈরির কাজে লাগলেন।
রোমের সিস্টিন চ্যাপেল, মক্কার প্রধান মসজিদ কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসের স্টেপলস সেন্টারে যে সাউন্ড সিস্টেমগুলো বসানো, সেনাবাহিনী, বিমানসংস্থা এমনকী নাসার মহাকাশচারীরাও যে হেডফোন ব্যবহার করছেন, সে সবই তার কোম্পানির সৃষ্টি! ‘বোস’। নামে নয়, স্পিকারের ওপর খোদাই করা চারটি ইংরেজি অক্ষরে খোদাই করা পদবিই তাঁর পরিচয়। অডিও সিস্টেম তথা ধ্বনিবিজ্ঞানের জগতে এমনই অবিশ্বাস্য বিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। দুনিয়া হয়তো ‘বোস কর্পোরেশন’-এর প্রাণপুরুষ হিসেবেই বেশি মনে রাখবে তাঁকে।
যিনি দেখিয়েছিলেন, কনসার্ট হলে বসে গান শোনার অনুভূতি বাড়ির বৈঠকখানায় বা চলন্ত গাড়িতেও তুলে আনা যায়। কিন্তু শুধু এটুকু বললে অমরের প্রতি অন্যায় হবে। কারণ, একাধারে তিনি বিজ্ঞানী, অধ্যাপক এবং শিল্পপতিও বটে। উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর ব্যবসাবুদ্ধি লক্ষ্মী-সরস্বতীর বিরল সমন্বয় তাঁকে এনে দিয়েছিল বিশ্বের প্রথম ৪০০ কোটিপতির তালিকাতেও। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ব্যবসা শুরু করেছিলাম অন্য রকম কিছু তৈরি করব বলে। অর্থ উপার্জনের জন্য নয়।” তাঁর দীর্ঘ গবেষণার কথা মনে করিয়ে সে দিন সহাস্যে জানান, “অন্যের সংস্থায় কাজ করলে হয়তো কয়েকশো বার চাকরি খোয়াতাম!”
সুর-তাল-ছন্দের প্রতি টান ছিল ছোটবেলা থেকেই। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে ভালবাসতেন। কিন্তু তাল কেটে দিত আশপাশের বাড়তি আওয়াজগুলো। কিশোর বয়সে রেডিও সারাইয়ের অভিজ্ঞতা ছিলই। তার সঙ্গে জুড়ল ইঞ্জিনিয়ারের মেধা। প্রেক্ষাগৃহে শব্দের প্রতিফলনের তত্ত্ব কাজে লাগিয়েই এমন এক সাউন্ড সিস্টেমের নকশা বানিয়ে ফেললেন, যাতে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট স্পিকার, দেওয়ালের দিকে তাক করা। অর্থাৎ শুধুই সরাসরি স্পিকারের শব্দ নয়, শ্রোতাকে প্রতিফলিত শব্দ শোনানোরও বন্দোবস্ত। প্রেক্ষাগৃহের মজা বাড়িতে পাওয়ার রেসিপি হল এই দুইয়ের মিশেল। চলতে লাগল নিরন্তর পরীক্ষা।
‘বোস কর্পোরেশন’-এর জন্ম হল ১৯৬৪ সালে। তাঁদের প্রথম তৈরি সাউন্ড সিস্টেমটা অবশ্য তেমন সফল হয়নি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে যেটা বাজারে আসে, সেই ‘বোস ৯০১ ডিরেক্ট/রিফলেক্টিং’ স্পিকার সিস্টেম’পরের টানা ২৫ বছর ‘বেস্ট সেলার’ থাকে। ক্রমশ ‘বোস’-এই ভরসা রাখে সেনা থেকে নাসা। যন্ত্রগুলো অবশ্য আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। কারণ, আকাশছোঁয়া দাম। ‘বোস’-এর সাউন্ড সিস্টেমই যে দু’টো ব্র্যান্ডের গাড়িতে ব্যবহার হয়, তার একটা হল পোর্শে, অন্যটা মার্সিডিজ।
এমন মহামূল্য যন্ত্র তৈরি করলো কে জানেন ? যিনি আদতে এক মধ্যবিত্ত, ব্রিটিশ পুলিশের ভয়ে দেশছাড়া এবং অনুপ্রবেশকারী এক বাঙালির সন্তান। বাবা ননীগোপাল বোস ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোপনে চালিয়ে যাচ্ছিলেন স্বাধীনতার লড়াই। ননীগোপাল এক বার বন্দিও হলেন পুলিশের হাতে। কোনও মতে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই পালিয়ে গেলেন মার্কিন মুলুকে। সালটা ১৯২০। শুরু করলেন আমদানি-রফতানির ব্যবসা। বিয়ে করলেন এক মার্কিন স্কুল শিক্ষিকাকে। ১৯২৯ সালে জন্ম হলো এই সফল বাঙালির…..অমর গোপাল বোস ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, কিশোর অমর তখন হাতখরচ জোগাতে ফিলাডেলফিয়ার একটা রেডিও-র দোকানে কাজ করেন। বাবার ব্যবসা লাটে উঠলে স্কুলের বন্ধুদের নিয়েই তিনি শুরু করেন দোকান। মডেল ট্রেন, রেডিও সারিয়ে রোজগারের অর্থ তুলে দিতেন বাবার হাতে। এই সময়েই কয়েকটি পরিবারের মধ্যে হ্যাম রেডিও পর্যন্ত চালু করে ফেলেছিলেন। এ সব করতে গিয়ে কিন্তু পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেনি।
অ্যাবিংটন হাই স্কুল থেকে পাশ করে ভর্তি হন এমআইটিতে। প্রথমে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিয়ে স্নাতক। পরে সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি। স্কলারশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য দিল্লিতে গবেষণা করতে এসেই ভাবী স্ত্রী প্রেমার সঙ্গে আলাপ। তাঁদের দুই সন্তান ভানু গোপাল বোস এবং মায়া বোস। প্রেমার সঙ্গে বিয়ে অবশ্য টেঁকেনি। বিবাহবিচ্ছেদের পর অমর দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন উর্সুলাকে।
১৯৫৬ সালে এমআইটি-র অধ্যাপকের পদে যোগ দেন অমর। পরের ৪৫টা বছর অধ্যাপনার সঙ্গেই চলে গবেষণা। দক্ষ হাতে সামলান সংস্থার কাজও। অমরের গোটা জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে যায় এমআইটি। তাই ২০১১ সালে সংস্থার শেয়ারের বেশির ভাগটাই দান করেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। এতে ‘বোস’-এর লভ্যাংশের অর্থ ঢুকবে এমআইটি-র ঘরে।
১২ই জুলাই ২০১৩ দুনিয়া থেক বিদায় নিলেন বিজ্ঞানী ও শিল্পপতি অমরগোপাল বোস। ৮৩ বছর বয়সে আমেরিকার ওয়েল্যান্ডে নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন মার্কিন মুলুকের অত্যন্ত সফল এই বঙ্গসন্তান।