নেচার পত্রিকায় মোদী সরকারের সমালোচনা – আলোড়ন রাজনৈতিক মহলে
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান-সম্পর্কিত পত্রিকা ‘নেচার’ এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণে ভারতে বেড়ে চলা হিংসার ঘটনা সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে এই দেশে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে। এবং তা রক্ষা করার দায় বর্তায় ভারত সরকারের ওপর।
নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়র বাংলা অনুবাদ:
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব দেখেছে ভারতের নাগরিকরা, বিশেষ করে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। বৈষম্যমূলক নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের নিদর্শন হিসাবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সমবেতভাবে ভারতীয় সংবিধানের উপস্থাপনাটি পড়ছেন।
নতুন আইনে বলা হয়েছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত সাম্প্রতিক শরণার্থীদের নাগরিকত্বের পথ প্রসস্ত করা হবে। এই দেশগুলিতে নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার এই প্রয়াস প্রশংসনীয়। কিন্তু উদ্বেগজনক হল ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে কে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে এবং করতে পারে না – সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মুসলমানদের বাদ দেওয়া হবে। এর ফলে লংঘিত হবে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার, যা সকল ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখে।
এই আইনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে তার প্রত্যুত্তর মিলছে হিংসায়। এবং রেহাই নেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলিরও। এটি খুবই দুঃখজনক। সর্বশেষ হাই-প্রোফাইল ঘটনাটি নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) এ ঘটেছিল, যেখানে শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদও করে চলেছেন। ৫ জানুয়ারীর সন্ধ্যায়, মুখোশ পরা কিছু লোক লাঠি, পাথর এবং লোহার রড নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এবং আক্রমণ শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর রিপোর্ট অনুযায়ী শহরের পুলিশ সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
রক্তাক্ত এবং আহত শিক্ষার্থী এবং কর্মীদের ভিডিওগুলি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃত বিভাগের দৃষ্টিশক্তিহীন শিক্ষার্থী সূর্য প্রকাশকে তাঁর ঘরে মারধর করা হয়েছিল। আঞ্চলিক উন্নয়ন অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষক সুচরিতা সেন দাবি করেছেন যে তাঁর মাথায় “ইটের আকারের একটি পাথর দিয়ে” আঘাত করা হয়েছিল।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, পুলিশ ভারতের দুটি পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিল – নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়, সম্পত্তির ক্ষতি হয় এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহৃত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হয়েছিল, পাঠদান এবং গবেষণা ব্যাহত করে। জামিয়া মিলিয়ার উপাচার্য নাজমা আখতার বলেছিলেন যে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করা পুলিশের কাছে কাম্য নয়।
পুলিশি পদক্ষেপের তীব্রতা যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠের মধ্যে রয়েছেন নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্তমানে কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অর্থনীতিবিদ এবং জেএনইউ এর প্রাক্তন ছাত্র। এছাড়াও ভারতে স্নাতকস্তরে শিক্ষা প্রাপ্ত লন্ডনের জীববিজ্ঞানী এবং লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি, ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন এই নতুন আইনের সমালোচনা করছেন।
সরকারের সমর্থকরা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানীরাও নতুন আইনের বিরোধিতা করছেন। তবে তাদের অবশ্যই জেনে রাখা উচিত যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান ভিত। সরকারী নীতির বিরুদ্ধে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করাটা মানুষের অধিকার সুবিধা নয়। সরকারের উচিত এই অধিকার রক্ষা করা। এই অধিকার না থাকলে বিরোধীরা নিজেদের বক্তব্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারবেন না। ভুলে গেলে চলবে না, ক্ষমতায় আসার আগে বর্তমান শাসক দলও এই অধিকার পেয়েছিল।
ভারত এবং বিশ্বজুড়ে শিক্ষাবিদরা সন্ত্রস্ত এবং প্রতিবাদ করছেন। তাদের পদক্ষেপ যথাযথ কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বল প্রয়োগ করা হয়েছে, ফলে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারের উচিত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্রছাত্রীদের এবং সাধারণ মানুষের বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
তাদের অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কৃষ্ণস্বামী বিজয় রাঘবনের কথা শোনা, যিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন: “বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলি বিভিন্ন মতামত আদান প্রদান, গবেষণার, আলোচনা, এবং সমষ্টিগত বিতর্কের স্থান। সেখানে হিংসার কোনও স্থান নেই। ”