বাংলায় বর্গী হানা – ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়
এককালে গোয়েবলস বলেছিলেন একটা মিথ্যাকে বারবার বলতে থাকলে তা সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলস ছিলেন সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এবং অন্তিমে পরাজিত স্বৈরাচার জার্মানির হিটলারের প্রচার সচিব। বর্তমানে আমাদের দেশেও আমরা দেখছি এই প্রবণতা। যারা নিয়ামক, তারাঅতীতকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট। শাসনক্ষমতা অর্জন করেই নিজেদের আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী কেবল ভবিষ্যতের কর্মসূচি প্রণয়ন নয়, অতীতের ইতিহাসকেও পুনর্লিখনে উদ্যোগী হয়েছে এক দল।
ইতিহাস বিস্মৃতির এই খেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যম। ইদানিং কালে দেখা গেছে যে সিনেমার মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতির একটি প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এবং অনেক ঘটনার কথাই ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ১৭৪১ সালের বর্গী হানা সেইরকম একটি ঘটনা।
রাস্তার নাম অনেক ইতিহাসের কথা বলে। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে এমনই একটি রাস্তা আছে মারাঠা ডিচ লেন। বর্গী হানাদারদের রুখতে এখানে সত্যিই ১৭৪০ এর দশকে একটি পরিখা খনন করা হয়েছিল।
বর্গীর গিরি
বর্গী শব্দের উৎপত্তি মারাঠা শব্দ ‘বর্গীর’ থেকে যার অর্থ ‘অশ্বারোহীর দল’। দাক্ষিণাত্যের অন্যতম প্রদেশ আহমেদনগরের প্রধানমন্ত্রী মালিক অম্বর এক ধরণের গেরিলা রণকৌশলের উদ্ভব করেছিলেন, যার নাম ‘বর্গীর গিরি’। এই কৌশলটি শিবাজী, এবং পরবর্তীতে মারাঠা সেনা আয়ত্ত করে।
১৭৪১ সালে নাগপুরের শাসক রঘুজি ভোঁসলের বর্গী সেনা ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে বাংলার পশ্চিম দিকে হানা দেয়। ‘বর্গীর গিরি’ কৌশল ব্যবহার করে তারা বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের সেনাদের হতবাক করে দেয়। বাংলার সেনা পরাক্রমের সঙ্গে বর্গীদের কয়েক বার হারিয়েও দেয়। কিন্তু, বর্গীদের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র লুঠ করা এবং কার্যসিদ্ধি তারা করেছিল।
১০ বছর ধরে লুঠতরাজ চালায় মারাঠা বর্গীরা, যার ফলে বাংলার অর্থনীতি অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে ওঠে। সেই সময়কার পর্তুগীজ নথি অনুযায়ী বর্গী সেনারা বাংলায় ৪ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। এদের মধ্যে বণিক শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক।
এক বাঙালি কবি গঙ্গারাম ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ নামক এক কাব্যগ্রন্থে বাংলায় বর্গী হানা সম্পর্কে সুবিস্তারে লিখে গেছেন। এছাড়াও রচিত হয়েছে নানা ছড়া।
ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি?
আর কটা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি
কলকাতার পরিখা
শুধু যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লুঠতরাজ চালিয়েছিল বর্গী সেনা, তা নয়। প্রদেশের রাজধানীতেও আঘাত হানে তারা। মুর্শিদাবাদে যেখানে ধনকুবের জগত শেঠ বাস করত, সেখানেও তারা হামলা চালায়।
কলকাতায় তারা আক্রমণ না করলেও সুরক্ষার খাতিরে পরিখা খোঁড়া হয়। এর দক্ষিণ প্রান্তকে বলা হত আসল কলকাতা। পরবর্তীতে এই পরিখা বুজিয়ে ফেলা হয়। এর ওপরেই নির্মিত বর্তমানের আপার সার্কুলার রোড।
লাগাতার আক্রমণের পর বর্গী আক্রমণ বন্ধ করার জন্য বাংলার নবাব রঘুজি ভোঁসলেকে উড়িষ্যার শাসনভার প্রদান করেন।
বর্তমানের চোখে সেই সময়
আজকাল মারাঠাদের সাধারণত দেশপ্রেমী হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। অনেক ভারতীয় মনে করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ মারাঠারা এগিয়ে নিয়ে গেছিল। ইতিহাসের এই অধ্যায় বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছে।
তথ্যসূত্র: শোয়েব দানিয়াল