সঙ্কটের মাঝেও মানবিকতা – ক্ষীরাই
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মেদিনীপুরের ছোট্ট গ্রাম ক্ষীরাই আজ শহুরে বাঙালির একদিনের ছুটির প্রধান গন্তব্য। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। পৌষ পার্বনের ছুটি পেয়েই ছুটলাম বহুল চর্চিত সেই ফুলের দেশে। কাঁসাই (কংসাবতী) নদীর শুকনো উপত্যকায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে ফুল-চাষিদের দিন রাতের অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রথম দর্শনেই মন ভরে যায়। কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে রঙ বেরঙের ফুলগুলি সদ্য শীত ঘুম ভাঙার আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন। শুরু হয়ে গেছে চাষিভাই দের আনাগোনা।
সংকীর্ণ আল পথ ধরে নদীর দু প্রান্তে ফুটে থাকা গাঁদা-আস্টার-মোরগঝুঁটি-করন-চন্দ্রমল্লিকা’র অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে বোঝাই গেল না কখন বেলা গড়িয়ে গেছে। হুঁশ ফিরল একঝাঁক আগন্তুকের কোলাহলে। দেখি ওরাও আমাদের মতই প্রকৃতির নেশায় ছুটে এসেছে। কিন্তু ওদের প্রকৃতিপ্রেম যে বড়ই উগ্র। ফুলের ক্ষেতে নিজস্বী তোলা থেকে সর্ষে ক্ষেতে DDLJ পোজ- সর্বত্রই অবিবেচক ঔদাসীন্য চোখে পড়ার মত। আস্টার-গাঁদায় নিজেকে ফুলকুমারী সাজানোটাই যেন ক্ষীরাই আসার আসল উদ্দেশ্য। কিছু সময় আগেই জনৈক এক চাষিভাই এর কথায় ঠিক এই উদ্বেগ ই ধরা পড়ছিল। আরও জানা গেল সংলগ্ন স্থানটি ক্রমশই শীতকালীন বিনোদনের এক জনপ্রিয় আখড়া হয়ে উঠছে। কিছু মহান বাবু আবার রক্ত-জলে তিলে তিলে গড়ে ওঠা রুটি-রুজির গাছগুলিকেও নেশাজনিত মত্ততার ঝোঁকে কিনে পর্যন্ত নিতে চায়। বড়ই উদার মন।
ওদিকে মকর সংক্রান্তির পূণ্যলগ্নে গ্রামের প্রতিটি ঘর সেজে উঠেছে উৎসবের আঙ্গিকে। ঘরে ঘরে চোখে পড়ল আসন্ন উৎসবের পরিচিত ব্যস্ততা। কিন্তু তার মধ্যেও ছিল না আন্তরিকতার বিন্দুমাত্র অভাব। অপরিচিত অতিথিকে মুহূর্তের আলাপচারিতায় পিঠে-পুলির নিমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা বোধ করে না তারা। গ্রামের শীতলা মন্দিরে চলছে মায়ের অন্ন ভোগের আয়োজন। মন্দিরের পুরোহিত ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের সরল আতিথেয়তায় বেশ কিছুটা পূণ্যার্জনের সাথে সাথে মধ্যাহ্নের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণও সম্ভবপর হল। ইট কংক্রিটের রাজত্বে ব্রাত্য হয়ে পড়া অদৃশ্য কিছুর প্রাপ্তিতে ভরে উঠল মন।
ক্ষীরাই কোন ফুলের জলসা নয়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সাথে ফুল-চাষিদের কঠোর জীবনযাত্রার মেলবন্ধনই হল এই “VALLEY OF FLOWER”। আর সমালোচনা কখনই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এই আশু বিপদের দিনেও আমরা মৌন হয়ে থাকলে “ইতিহাসের আর এক নাম ক্ষীরাই” শিরোনাম হতে বেশি দিন লাগবে না।