বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

সুভাষের উত্তরাধিকার

January 23, 2020 | 3 min read

সুভাষ চন্দ্র বসুর কাহিনী অদ্ভুত এক ধাঁ ধাঁ, যা আদ্যোপান্ত রহস্যে মোড়া। আর সেই মোড়কের ভিতরেও রহস্য! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইনস্টন চার্চিল রাশিয়াকে ব্যবহার করতে গিয়ে ঠিক এমনই এক উপমা ব্যবহার করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, নেতাজির গল্পের সঙ্গেও রাশিয়ার একটি ঘনবিষ্ট সংযোগ রয়েছে।
১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুবিমান দুর্ঘটনায় আদৌ তাঁর মৃত্যু হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা হয়েছে এবং আজও তাতে কোন ঘাটতি পড়েনি। কিন্তু এই গল্প যে নিছক ওই বিমানবন্দরেই থেমে যায়নি, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, বরং তার যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। অনেকের বিশ্বাস ও মত, তিনি রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন; জাপান যখন বশ্যতা স্বীকারের মুখে, এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়া আর জাপানের মধ্যে জোট নির্মাণের লক্ষ্যে। কিন্তু, এরপর কি ঘটেছিল, সেই কাহিনী ঝাপসা। কেউ বলেন, রাশিয়ার গুলাগ-এর অজস্র কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কোন একটিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। কারণ রাশিয়া তাঁকে একজন যুদ্ধপরাধী ছাড়া আর কোন রূপেই গণ্য করেনি। এই ঘটনায় অনেকে এমন ইঙ্গিত যোগ করেন – তাঁকে এই কারারুদ্ধ করে রাখার কথা ভারত নাকি জানত এবং তৎকালীন প্রশাসন এব্যাপারে কোনও রকম নাক গলাবে না, মধ্যস্থতা করবে না – স্থির করে নিয়েছিল। কারণ, সেসময়ের নেতৃত্বদের মনে হয়েছিল, ভারতে তাঁকে ফেরানো হলে তৎকালীন রাজনৈতিক সমীকরণ ঘেঁটে যেতে পারে।
মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরুর সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পরিকল্পনা ছিল সার্বিকভাবে তাঁদের অশুভ অভিসন্ধি, যাতে নেতাজি কোনভাবেই ভারতের সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে না পারেন। এমনটা হতেই পারে, কিন্তু কোথাও যেন কল্পনা করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন, সাধু বা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তিনি ভারতে ফিরে এসেছিলেন। গুমনামি বাবার কাহিনী সে মতেরই এক সংস্করণ। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ঘিরে আরও অনেকরকম কথা কাহিনী জুড়ে আছে। সেসবের কিছু প্রমান, তথ্যও রয়েছে।
কিন্তু, আসল প্রশ্ন হল – আজকের ভারতে নেতাজির ভূমিকা কি হতে পারতো? ‘জাতীয়তাবাদ এর নামে ভ্রষ্ট উন্মত্ত মানুষরা দেশের গণতন্ত্র উপড়ে ফেলতে তৎপর – হালে দেশের এই তো পরিস্থিতি! এমতাবস্থায় রাজনীতিকে আমরা যেভাবে দেখি, নেতাজির আদর্শ হয়তো সেই ক্ষেত্রে অপরিহার্য কিছু মউলিক বদল এনে দিতে পারতো। নিশ্চিতভাবে, ধর্ম ও জাতি সেখানে কোনভাবেই অগ্রাধিকার পেত না, বরং থাকতো সবার পিছনেই।
অনেকেই নেতাজিকে ফ্যাসিস্টদের জোটসঙ্গী বলে মনে করেন, যেহেতু, ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি তেমন কিছু নেতার সঙ্গে মধ্যস্থতায় গিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে যেহেতু গান্ধী, নেহেরু এবং সর্দার প্যাটেলের প্রকাশ্য বিরোধিতা তিনি করেছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের রাজনীতিতে নেতাজিতে কোথাও যেন বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু, কোনমতেই তিনি বহিরাগত নন। ভারতকে স্বাধীন করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। এবং এই লক্ষ্য পূরণের জন্য বিশ্বের সেই সব নেতার সঙ্গে মধ্যস্থতায় যাওয়া ও গান্ধী-নেহেরু বিরোধিতার অবস্থানকে নেতাজি রাজনীতিগত ভাবে উপযোগী বলে মনে করেছিলেন বলেই তা করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা ব্যতিত আর কোন বিষয়ে তাঁর মাথাব্যাথা ছিল না। স্বাধীনতা আনতে মহাত্মা গান্ধীর পন্থাকে যারপরনাই শ্লথ ও ব্যর্থ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়েছিল।
তিনি হয়তো ঠিক ছিলেন, হয়তো বা ভুলই ছিলেন। কিন্তু, একটা বিষয়ে তাঁর সমস্ত ভুল ধুয়ে মুছে যায়। তাহল, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তাঁকে নির্বিকল্প রূপে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
ভারতের স্বাধীনতার সময় তিনি যদি থাকতেন তাহলে একটা ব্যাপার নিশ্চিত ছিল – আমাদের রাজনীতি হত অনেক অনেক স্বার্থপরতাহীন, অসুয়ারহিত, দুর্নীতিমুক্ত। হত জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার দূষিত বাধ্যবাধকতা থেকে দূরগামী। ‘জাতীয়তাবাদ’ এর ধারণাকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করে তিনি আরও গ্রহণযোগ্য রূপ দিতে পারতেন। আর হ্যাঁ প্রজাতান্ত্রিক এই দেশে বাংলা অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হত। আজকের মতো প্রান্তবাসী হিসেবে আমাদের দেখা হত না, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাচে আমাদের বারংবার অপদস্ত হতে হয়। যেখানে, আমাদের প্রকৃত ভবিতব্য থেকে আমরা বারবার ব্রাত্য হই।
হয়তো এমনও হতে পারে আমি ভুল ভাবছি, নেতাজি ফিরে এসেছিলেন ঠিক এবং এসে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতকে দেস্খে তিনি এতটাই হতভম্ভ হয়েছিলেন যে, অগোচরে অন্তরালে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের কাছাকাছি কোনও এক ছোট্ট শহরে তিনি গোপনে থেকে গেলেন তাঁর লড়াইয়ের, সংগ্রামের স্মৃতি বুকে নিয়ে। যে লড়াই তিনি লড়েছিলেন তাঁর ‘ভারত’ এর জন্য এবং হেরে গিয়েছিলেন। অন্য ভারত দেখে তিনি আড়াল হয়ে গেলেন। সত্যি বলতে, এতে আমার আশ্চর্য লাগে না।
এমনকি আমার প্রজন্মের অনেকেই আমার মতন আশ্চর্য হন না। আমরা আমাদের তরুণ বয়সে যে দেশের স্বপ্ন দেখতাম, সে স্বপ্ন বহু আগেই কালের গর্ভে চাপা পড়ে গিয়েছে। উপরে রয়েছে কেবল লজ্জা আর কদর্যতা। তাকে আমরা আজ ‘রাজনীতি’ বলে ডাকি।
গেরুয়ার উত্থান মানে গণতন্ত্রের মৃত্যু – একথা আমরা বহু দশক আগেই বুঝে ফেলেছিলাম এবং আমাদের মাঝে যারা অন্ধ হয়ে আছে, তারাও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে
লেখনী: প্রীতীশ নন্দী (প্রবন্ধটি সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Netaji Subhas Chandra Bose

আরো দেখুন