কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ডাইনোসরের কঙ্কাল
জাদুঘরে ডাইনোসর নেই, আছে বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে। সেটি রবীন্দ্রনাথের নামেই নামাঙ্কিত। শুনতে অদ্ভুত লাগছে না? একটু গোড়া থেকেই শোনা যাক। ১৮৯৩ সালের ২৯ জুন নীরোদবাসিনী দেবী এবং প্রবোধচন্দ্র মহলানবিশের প্রথম সন্তান প্রশান্তচন্দ্রের জন্ম হয়। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গুরুচরণ মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে প্রশান্তচন্দ্রের শিক্ষারম্ভ হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১২-য় পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক বিএসসি পাশ করেন। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে তিনি ‘ট্রাইপস’ পাশ করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেছিলেন।
দেশে ফিরে ১৯১৫-য় তিনি প্রেসিডেন্সিতেই পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হন। রাশিবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ ছিল বলে এখানেই কয়েক জনকে নিয়ে তিনি একটি স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি ১৯২০-র কথা। সার্বিক ভাবে দেশের আবহাওয়া, বন্যা অথবা নৃতত্ব বিষয়ে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে এখানে উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু হয়। কিন্তু তাঁর মনের একান্ত ইচ্ছে ছিল রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
১৯৩৩-এ ওঁর সেই স্বপ্নপূরণ সম্ভব হয়, তৈরী হয় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। ১৯৪০-এ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ বরাহনগরে একটি পুরনো বাগান বাড়ি কিনেছিলেন। সবুজ গাছপালা পুকুর সম্বলিত এই বাড়িটি সংস্কার করে এখানেই তিনি থাকতে শুরু করেন। শিক্ষক জীবনের সঙ্গেই ওঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে থাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ক্রমে সেই পরিচয় গাঢ় হয়। নিজের জীবন ও মননে রবীন্দ্র আদর্শকে গ্রহণ করেন প্রশান্তচন্দ্র।
ওনার তৈরী ইনস্টিটিউটটি পরে এখানেই স্থানান্তরিত হয়। প্রশান্তচন্দ্র রাশিবিজ্ঞানে অনেকগুলি সূত্র এবং পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। নমুনা সমীক্ষায় একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রের জন্য ১৯৪৫ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। প্রশান্তচন্দ্রের আন্তরিক উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটতে থাকে।
ওঁর ভাবনায় ছিল এই বৃহৎ দেশের নানাবিধ বিষয়। একসময়, গণ্ডোয়ানা-ল্যান্ড যখন ছিল সেই সময় এ দেশেও চড়ে বেড়াত বৃহদাকার ডাইনোসরের দল। পরে ভূতাত্ত্বিক প্লেট সরে যাওয়ার সময় সেই ডাইনোর দল চলে যায় অন্যত্র। কিন্তু এখানে রয়ে যায় তাদেরই একটির কঙ্কাল। বিজ্ঞানের এই বিষয়গুলি নিয়েও ভাবিত ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। এ বিষয়ে এক দিন নতুন কোনও আশার আলো দেখা যাবে এই বিশ্বাস ছিল তার মনে।
১৯৫৭-য় গবেষক-অধ্যাপক পামেলা লামপ্লাউ রবিনসনকে আমন্ত্রণ করেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে উনি এসে হাজির হন এখানে। বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে তিনি একটি ভূতাত্ত্বিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশের ভূতাত্ত্বিক বিষয়গুলি নিয়ে নতুন ক্ষেত্রের গবেষণা করা। রবিনসনের নেতৃত্বে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কোল ঘেঁষে গোদাবরী উপত্যকায় অনুসন্ধান শুরু হয়। এই অনুসন্ধানের ফলে কিছু ফসিল মাছ পেয়ে যান তাঁরা। পরে ১৯৬১-তে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা একটি ডাইনোসরের হাড়গোড় আবিষ্কার করেন গোদাবরী উপত্যকায়। ভারতে প্রথম এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর কয়েক টন হাড় কলকাতায় এনে জড়ো করা হয়। অতঃপর, আবিষ্কারস্থলের ছবি মিলিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয় এই ডাইনোসরটিকে। পাওয়া যায় অতিকায় প্রাণীটির পূর্ণাঙ্গ চেহারা। এর নাম দেওয়া হয় ‘বরাপাসউরাস টেগোরেই’। বরাপাসউরাস শব্দের অর্থ বড় পা যুক্ত গিরগিটি এবং টেগোরেই শব্দটি যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। ঘটনাক্রমে সেই বছর ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। সে কারণেই এই উদ্যোগ।
এ ভাবেই এই উপমহাদেশের এক এবং অদ্বিতীয় ডাইনোসরের সঙ্গে জুড়ে গেছে কবিগুরুর নাম। যদিও সেই প্রাণীটির মাথা পাওয়া যায়নি সে সময়। পরে এই সংস্থার অনুরোধে বিদেশ থেকে একটি মাথা উপহার হিসেবে আসে এই প্রাণীটির ধড়ে। বরাহনগরের এই ক্যাম্পাসে কয়েক বার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রশান্ত এবং রানি মহলানবিশের এই বাড়িটির নাম আম্রপালি, সেটিও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সেই ডাইনোসরটি দেখা যাবে এখানকার ভূতাত্ত্বিক বিভাগের সংগ্রহশালায়, সঙ্গে রয়েছে সে দিনের অনুসন্ধান থেকে আবিষ্কৃত সেই সব মাছ বা অন্যান্য ফসিলের সম্ভারও।