ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের রয়্যাল কোট অব আর্মস কলকাতায়
রাজভবনের বাড়িটির প্রতিটা স্তম্ভ কোন দেশ এবং রাজ্যের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাস বহন করছে। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতিগত দিক দিয়েও বাড়িটির গুরুত্ব অসীম। ১৮৫৮-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ভাইসরয় অব ইন্ডিয়ার বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে বাড়িটি। অনেকে মনে করেন ডার্বিশায়ারে রবার্ট অ্যাডামস-এর কেডলেসটন হলের প্রভাব রয়েছে বাড়িটির স্থাপত্যে। এই বাড়ির বিরাট অলিন্দ ও জাঁকজমকপূর্ণ অন্দরসজ্জা সম্পর্কে অনেকে জানলেও এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের কথা আমাদের দীর্ঘ দিন অজানা ছিল।
রয়্যাল কোট অব আর্মস এমনই এক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ। মহারানি ভিক্টোরিয়া এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতীকস্বরূপ কোট অব আর্মস ব্যবহার করা হত। রাজভবনের চারটি কোণে এবং মূল দরজার ওপর যে ত্রিভূজাকৃতি অংশ, এখন যেখানে অশোকচক্র শোভা পাচ্ছে সেখানেই একসময় শোভা পেত কোট অব আর্মস। স্বাধীনতার পর সি গোপালাচারী গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার আগে রাজভবন সজ্জায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সেই সময় রাজভবন থেকে এগুলি খুলে ফেলা হয়েছিল।
ইংল্যান্ড এবং তৎকালীন ভারতের ইতিহাসে এই রয়্যাল কোট অব আর্মস-এর গুরুত্ব অপরিসীম। রানির নামে ব্যবহৃত এই প্রতীকটি আদালতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিতে দূতাবাসে ব্যবহার করা হয়। ইংল্যান্ডের চার্চগুলিও রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে রয়্যাল কোট অব আর্মস ব্যবহার করে। মনে করা হয় এই সব কারণেই ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ভাইসরয় অব ইন্ডিয়ার বাসস্থানে কোট অব আর্মস বসানো হয়েছিল।
কোট অব আর্মস দেখতে অনেকটা শিল্ডের মতো, যা চার ভাগে বিভক্ত। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওপরের বাঁ দিক এবং নীচের ডান দিকে ইংল্যান্ডের প্রতীক থাকে। ওপরের ডান দিক আর নীচের বাঁ দিকে থাকে ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান লায়ন। ওপরে একটি বড় সিংহ থাকে যেটি স্কটল্যান্ডের রাজকীয় প্রতীক। নীচে থাকে একটি হার্প। যেটি আয়ারল্যান্ডের রাজকীয় প্রতীক। শিল্ডের চারিদিকে রয়েছে একটি বেষ্টনী। যেখানে খোদিত আছে ‘অনি সওই কুই মাল ইয়া পেনস’। এর অর্থ, যারা মন্দ চিন্তা করে তাদের ধিক্কার।
শিল্ডের মাথায় রয়েছে সোনার মুকুট পরা সিংহ। শিল্ডের ডেক্সটার এবং সিনস্টার সাইডে রয়েছে যথাক্রমে সিংহ এবং ইউনিকর্ন। ইউনিকর্ন চেন দিয়ে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে কারণ মুক্ত ইউনিকর্নকে বিপজ্জনক মনে করা হয়। সিংহ আর ইউনিকর্ন একটা ছোট ফ্রেমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যার নীচে রয়েছে তিন রকমের ফুল পাতা। থিসল, টিউডর রোস আর সামরক। এরা যথাক্রমে স্কটল্যান্ড ইংলন্ড আর আয়ারল্যান্ডের প্রতীক। এর নীচে রয়েছে আর একটি নীতিবাক্য, ‘দিউ ই মঁ দোঁয়া’ যার অর্থ ঈশ্বর এবং আমার অধিকার। বর্তমান রাজপরিবার এই নীতিবাক্যই অনুসরণ করে।
কোট অব আর্মস পুনরুদ্ধারের ইতিহাসটিও বেশ চিত্তাকর্ষক। প্রাক্তন গভর্নর গোপালকৃষ্ণ গাঁধী রাজ্যপাল থাকাকালীন অবসর পেলেই সুপ্রাচীন এই বাড়িটির বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে দেখতেন। এক দিন রাজভবনের প্রশস্ত বাগানে পায়চারী করার সময় তিনি দেখতে পান মাটির নীচ থেকে ভাঙা লোহার বেশ কিছু টুকরো উঁকি দিচ্ছে। সেই রকমই একাধিক টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আশপাশে। এর মধ্যে একটা বড় সিংহের মাথাও ছিল। কৌতূহলী হয়ে সেইখানে খননের নির্দেশ দেন তিনি।
এর পরই মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসে লোহা দিয়ে তৈরী এমন কিছু জিনিস যা দেখলেই বোঝা যায় যে কোনও এক সময় এগুলির সঙ্গে রাজভবনের ঐতিহ্যের যোগ ছিল। এগুলিকে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু তত দিনে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। রাজভবনের দক্ষিণের বাগানে জিনিসগুলিকে জড়ো করে রাখা হয়।
পরবর্তী রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন পুরো ব্যাপারটি জেনে পুনর্গঠনের কাজটি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ বা সংক্ষেপে ইনটাক নামে একটি সংস্থাকে দেন। ভাঙা টুকরোগুলি দেখে সংস্থাটি ধারণা করে যে টুকরোগুলি আসলে রয়্যাল কোট অব আর্মস-এর অংশবিশেষ। রাজভবনের নথিপত্র এবং পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে এইটুকু বোঝা যায় যে ১৮০৩-এর আগে এটি তৈরী করা হয়েছিল।
লোহার এই সুবিশাল টুকরোগুলিকে জোড়া লাগিয়ে সেগুলিকে ঠিক আকার দেওয়ার কাজটা খুব সহজ ছিল না। ১০০ টনের মতো ওজনও ছিল সবকটা আর্মসের। দীর্ঘ দিন মাটিতে থাকার ফলে বেশ কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এ ছাড়াও বেশ কিছু অংশের কোনও হদিশ পায়নি সংস্থাটি। ফলে টুকরো জোড়া দেওয়ার কাজটি আরও কঠিন হয়ে যায়। কাজটি করার জন্য টুকরোগুলি জোড়া লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন টুকরো তৈরী করা দরকার ছিল। মেসার্স ম্যাকফারলেন্স গ্লাসগো বলে একটি কোম্পানি সেই সময় রয়্যাল কোট অব আর্মটি তৈরী করে।
বহু দিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে কোম্পানিটি। এর পর যোগাযোগ করা হয় গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে। এখানে সমস্ত স্কটিশ কোম্পানির তৈরী প্রতীকের প্রতিকৃতি রাখা ছিল। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষকে যথাযথ ভাবে ঔপনিবেশিক চেহারা দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে যা যা প্রতীক তৈরী হয়েছিল সেগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এখান থেকে বিষয়টি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা তৈরী হয়। এই বিষয়ে বিশদে জানার জন্য এর পর যোগাযোগ করা হয় ব্রিটিশ হেরিটেজ-এর সঙ্গে, যারা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ব্রিটেন-এর অংশ। এদের কাছ থেকেও বেশ কিছু সাহায্য পাওয়া যায়।
ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মোট চারটি কোট অব আর্মস ছিল। দু’টি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এবং দু’টি মহারানি ভিক্টোরিয়ার। ১৮৫৭-র পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়, চারটি রানি ভিক্টোরিয়ার কোট বসানো হয়। এর পর পঞ্চম কোট অব আর্মসটি রাজভবনের সামনের ত্রিকোণাকৃতি জায়গায় বসানো হয়। কোনও কোনও ইতিহাসবীদ মনে করেন, লর্ড কার্জন পঞ্চম কোট অব আর্মসটা বসান। ইনটাক-এর আহ্বায়ক জিএম কপূর জানান, এই টুকরোগুলিকে যথাস্থানে বসানো রীতিমতো কঠিন ব্যাপার ছিল। প্রায় জিগস পাজ়লের মতো কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, দু’টি গুরুত্বপূর্ণ টুকরো নিখোঁজ। সেই দু’টিকে ছাড়াই কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। এর পর রাজভবনের সামনের খোলা জায়গায় একটি উঁচু বেদীর মতো করে বসানো হয় রয়াল কোট অব আর্মস।
রাজভবন ছাড়াও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রয়্যাল কোট অব আর্মস রয়েছে। যদিও দু’টির ডিজাইনে সামান্য তফাৎ আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাধীনতার পর সরকারি ভবন বলে রাজভবনেরটি খুলে ফেলা হলেও ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে তৈরী করা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কোট অব আর্মসটি খোলা হয়নি।