ধর্মের বেড়া ভেঙে আরাধনা সরস্বতীর
পুজো তো হচ্ছে অনেক। কিন্তু ওঁরা চেয়েছিলেন একটু অন্য রকম কিছু হোক। ভেঙে যাক প্রচলিত নানা ধারণা। ভাঙুক ব্রাহ্মণ্যবাদের বেড়াজাল, ভেঙে যাক নারী-পুরুষের বিভেদ। তথাকথিত এলিট ক্যাম্পাসে অন্তত সরস্বতী পুজোর ছলেই অংশগ্রহণ থাকুক সর্বহারাদের। বাগদেবীর আরাধনায় নিজেদের এই ভাবনা যাঁরা বাস্তবায়িত করলেন, তাঁরা একে অপরের বন্ধু। ঘটনাস্থল বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আইএসআই, কলকাতা।
প্রথা ভেঙে এ বার সরস্বতী পুজোর আয়োজন করতে চেয়েছিলেন সেখানকার পড়ুয়ারা। ফেসবুকে নিজেদের গ্রুপে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও করেন। বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানের সিভি রামন ছাত্রাবাসে সরস্বতী পুজো করেন এক ছাত্রী, এক অব্রাহ্মণ ছাত্র এবং মুসলিম এক পড়ুয়া। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় একটি প্রদর্শনীর। যেখানে প্রদর্শিত সব ছবি টালা ব্রিজের তলা থেকে উৎখাত হওয়া পরিবারগুলির শিশু-কিশোররা এঁকেছে। চাঁদা সংগ্রহ করে ওই শিশু-কিশোরদের হাতে বই, খাতা, পেন, পেন্সিলও তুলে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে যারা এ বার মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী, তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে ব্যাটারি চালিত আলো।
অন্যতম আয়োজক সৌরদীপ্ত ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘এ বছরে আমাদের মধ্যে অন্য রকম কিছু করার তাগিদ তৈরি হচ্ছিল। প্রথাগত ভাবে পুরোহিত ডেকে পুজো করতে চাইছিলাম না। চেয়েছিলাম এই পুজোয় সকলেই অংশগ্রহণ করুক।’ পড়ুয়াদের একাংশ বলছেন, ‘আমাদের দেশ বহুত্ববাদের দেশ। কিন্তু অনেকে তার চরিত্র বদল করে যখন হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির ছক কষছেন, তেমন সময়ে এটা আমাদের একটা প্রতিবাদ বলতে পারেন।’
এই পুজোর জন্য খাটুনি অবশ্য কম হয়নি পড়ুয়াদের। যে তিন জন পুজোর কাজে ছিলেন, তাঁরা আচার-আচরণ তেমন জানতেন না। একটা মন্ত্র ও পুজো পদ্ধতির বই জোগাড় করে তিন চারদিন ধরে রীতিমতো রিহার্সাল করেছেন তাঁরা। পূজার্চনা করা ছাত্রী আরিসিনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘বুধবার রাতে তো ঘুমই হয়নি বলতে পারেন। রাত জেগে আমরা তিনজন পুজোর কাজ শিখেছি। মন্ত্র উচ্চারণ করেছি। পুজো পদ্ধতিগুলি করেছি।’ আবার কয়েকদিন ধরে আইএসআইয়ের পড়ুয়াদের কেউ কেউ টালা ব্রিজের তলা থেকে উৎখাত হওয়া পরিবারগুলির কাছে বারবার গিয়েছেন। কিছুদিন আগে সেখানকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। সেই প্রতিযোগিতার ছবিই এ দিন প্রদর্শিত হয়। আমন্ত্রণ জানানো হলেও ওই সব পরিবারের কেউ উপস্থিত হতে না-পারায় মন খারাপ আরিসিনাদের।
এই উদ্যোগকে ‘কালজয়ী’ বলে ব্যাখ্যা করছেন পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। তিনি বলেন, ‘অশিক্ষার থেকেও এই দেশটার সমস্যা হল কুশিক্ষা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই ভাবে কুশিক্ষাকে একদিন সরিয়ে দেবেন।’