বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

বাংলা সিনেমার স্টান্টম্যান – পরিচিতির অন্তরালে

February 1, 2020 | 3 min read

দুর্ধর্ষ স্টান্টম্যান। ছবি সোউজন্যেঃ poriborton

ঝপাং করে ঝাঁপ দিলেন নায়িকা। নায়িকাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপালেন নায়কও।
‘সুজন সখী’ সিনেমার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য। শুটিং চলছে কোলাঘাট রেল ব্রিজ ঘেঁষে। রূপনারায়ণ নদীর ধারে। ওদিক থেকে সবেগে ছুটে আসছে ট্রেন। যাত্রীরা হতবাক, চিৎকার জুড়েছেন। কারণ পর্দার দৃশ্যে দর্শক দেখছেন নদীতে ঝাঁপাচ্ছেন নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তাঁকে বাঁচাতে ঝাঁপাচ্ছেন নায়ক অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে? রেললাইনের ধার ঘেঁষে নদীর দিকে ছুটছেন ঋতুপর্ণার ‘বেশে’ প্রশান্ত গুপ্ত (গনু)। অভিষেকের ‘হয়ে’ সঞ্জীব জানা (বাবু)। ঝপাং। ঝপাং। দুটো শব্দ। সেই সঙ্গে আর একটা শব্দ, ‘কাট’।

‘জানেন দাদা, তখন তো আজকের মতো এত নিরাপত্তা ছিল না। তাই জানানোও হয়নি জল-পুলিশকে। ছিল না আমাদের কোনও ভয়ও। নদীতে সেখানে দাঁড়িয়ে মাত্র দুটো নৌকো। তার মাঝিরাই আমাদের বাঁচানোর সঙ্গী। জীবনের ত্রাতা। আর আমাদের জীবনের দাম? শুটিং শেষে দিনে ৯০-১০০ টাকা।’ টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর পিছনের মাঠে বসে, স্মৃতিকথা শোনাচ্ছিলেন সেই বাবু এবং গনু। সঙ্গে কেষ্ট (কৃষ্ণেন্দু ঘোষ)। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান স্টান্ট মাস্টার-অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টান্টম্যানরা।

কেউ মনে রাখেন না ওঁদের কথা। কেউ না। বছর কয়েক আগে, কলকাতার গঙ্গায় এমনই ঝাঁপ দিয়েছিলেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন ‘সেজে’ এক ডামি। মণিরত্নমের ‘রাবণ’ ছবির শুটিংয়ে। দু’দিন ধরে তাঁকে নিয়ে চলেছিল প্রচার। তারপর? কে আর মনে রেখেছেন তাঁকে? কে আজ মনে রেখেছেন রেশমা পাঠককে? ‘শোলে’ ছবির সেই দুর্ধর্ষ মহিলা স্টান্টম্যানকে? হোলি শেষে ‘গব্বর সিং’ আক্রমণ করেছেন রামগড়। প্রাণ বাঁচাতে আতঙ্কে ছুটছেন গ্রামবাসী। গব্বরের সঙ্গীদের ঘোড়ার পায়ের সামনে বসে অসহায় এক আর্ত শিশু। যেভাবে বাজপাখির মতো ছুটে এসে ভোল্ট খেয়ে ছোঁ মেরে বুকে জড়িয়ে রেশমা বাঁচিয়েছিলেন ‘সন্তানকে’, ছবি দেখতে বসে দর্শকদের তারিফ কুড়িয়েছিলেন তিনি। ‘শোলে’-র একটা সিগনেচার শট বলে সেই দৃশ্যকে আজও ধরা হয়। কিন্তু কেউ কি জানেন, সেই রেশমা আজ কেমন আছেন?

সন্ধ্যা নেমেছে মাঠে। আলো জ্বেলে একদিকে, টুক-টাক শব্দে বানানো চলছে ‘বব বিশ্বাস’ ছবির সেটের কাজ। অন্য দিকে টেবিলে এসে পৌঁছেছে চা-সিঙ্গাড়া। ‘আসলে কী জানেন? মুম্বই, দক্ষিণের ছবির কথা আলাদা। ওঁদের ছবির বাজেট বিশাল। মুম্বইতে আজ স্টান্টম্যান প্রায় আটশো, দক্ষিণে হাজার। সেখানে টালিগঞ্জে আজ আমরা ষাটজন টিম-টিম করে কোনও মতে টিকে রয়েছি।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে অভিমানের সুর কৃষ্ণেন্দুর গলায়। 

বলেও ফেললেন, ‘আসলে বাঙালি দর্শক নরম প্রকৃতির। প্রেমিক মনের। ছবিতে নায়ক-নায়িকার প্রেম, সেই প্রেম ঘিরে হাসি-মজা নিয়েই ছবি দেখতে ভালবাসতেন।’ যে কারণে উত্তমকুমার-সৌমিত্র-শুভেন্দু…সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী-মাধবীদের পাশে তুলসী চক্রবর্তী-ভানু-জহর-রবি-অনুপকুমার-চিন্ময় জুটিই ছিল হিট। সেখানে ফাইট কোথায়? আর অ্যাকশনই বা কোথায়?

‘অনুসন্ধান’ ছবিতে পরিচালক প্রভাত রায় ছিলেন শক্তি সামন্তের সহকারী। একে অমিতাভ বচ্চন। তায় বাংলা ছবি। সঙ্গে ‘ফেটে গেল ফেটে গেল, কালীরামের ঢোল।’ ছবিতে ছিলেন ‘কালীরাম’ আমজাদ খান। কিন্তু কে ছিলেন সেই ছবির ফাইট মাস্টার? প্রভাত রায় স্মৃতিমেদুর, ‘মুম্বইয়ের ফাইট মাস্টার শেট্টি ছিলেন ‘অনুসন্ধান’-এ। তা ছাড়া আমার ‘প্রতিদান’, ‘প্রতীক’, প্রতিকার’ সবেতেই তো ফাইট মাস্টার দরকার ছিল। কাজ করেছিলেন মুম্বইয়েরই মাসুদ পটেল।’

আসলে বাংলা ছবির চিত্রনাট্যের পরিবর্তনটা আসে আশির দশকের গোড়ায়। অ্যাকশন আসে স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরী, প্রভাত রায়, সুজিত গুহ, অনুপ সেনগুপ্তর মতো পরিচালকের গল্পে। প্রসেনজিৎ-চিরঞ্জিত-তাপস পাল-অভিষেক-ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাত ধরে। আর তখন থেকেই টালিগঞ্জ স্টুডিয়োতে গুটি গুটি আসতে শুরু করেন স্টান্টম্যানরা। ১৯৮৬ সালে তৈরি হয়, ‘মুভি স্টান্টম্যন অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন জোন, কলকাতা’।

‘তখন আমি সবে এসেছি জানেন। ছবিটার নাম ‘প্রজাপতি’। বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় নায়ক, নায়িকা শতাব্দী রায়। বিমল রায় ফাইট মাস্টার। দৃশ্যটা ছিল বিপ্লবদা আর অরুণদার দলের মধ্যে বোমাবাজি হচ্ছে। একটা বোমা উড়ে এসে ফাটল, একেবারে আমার বুকে। যদিও সেটা চকোলেট বোম। কিন্তু তার আগুনে ঝলসে গেল আমার বুক। প্রায় এক মাস বাড়িতে বসে ছিলাম। একটা পয়সাও পাইনি।’ চায়ে চুমুক দিয়ে, হাসতে হাসতে মন্তব্য কৃষ্ণেন্দুর।

‘একবার ‘যুদ্ধ’-র শুটিং করছি। ছবিতে মিঠুনদা আর জিৎ। অ্যাকশন সিন। জিৎ আমার মাথায় সজোরে ফাটাল একটা বিয়ারের বোতল। ছিটকে পড়ল কাচের টুকরো। সেই রকম এক্সপ্রেশনও দিয়েছিলাম। শট ওকে। কিন্তু পরে মাথায় ‘টের’ পেয়েছিলাম ব্যথাটা। তবে আজ আমাদের এগুলো গা-সওয়া। এই করেই তো আজ বেঁচে-বর্তে রয়েছি। এই গুটি কয়েক স্টান্টম্যান।’ খানিক নির্বিকার মাস্টার।

কিছু সময় গল্প করে যেন খানিক বোঝা গেল, ওঁদের হতাশার কথা। একদিকে বাংলা ছবিতে এখন অ্যাকশন গল্পের রমরমা আর নেই। তৈরি হচ্ছে ‘অন্য ধারার’ ছবি। যেখানে ফাইট তো নেইই, হচ্ছে সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী ছবি। তাই ওঁদের মুখে প্রসেনজিতের কথাই বেশি। কেন না ‘বুম্বাদা’র আমলেই ওঁরা কাজ করেছেন চুটিয়ে।

এখন যদি বা কোনও কোনও ছবিতে প্রসেনজিৎ-জিৎ-দেব অ্যাকশন করছেন। কিন্তু সেখানে স্টান্ট দিতে ‘মাস্টার’ হিসেবে মুম্বই থেকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে মাসুদ প্যাটেল, মহম্মদ মাখরানি, রডরিক্স, পাম্মাদের। চেন্নাই থেকে আগে আসতেন জুডো রামু, এখন আসছেন রকি, রাজেশ। এই তো ‘বব বিশ্বাস’-এই কাজ করছেন মুম্বইয়ের পাম্মা।

তা হলে তো সমস্যা?

‘সে তো বটেই। তবে আমাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। সেই অনুযায়ী ওঁদের সঙ্গে আমাদেরও কিছু ছেলেকে কাজ দিতে হয়। নয়তো আমরা বাঁচব কীভাবে! এখনকার সরকার অবশ্য আমাদের জন্য একটা ভালো কাজ করেছেন। অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় আমরা বিমা পাই… এইভাবেই চলছে। ছবিতে কাজ বেশি নেই। তবে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে এখনকার সিরিয়াল আর ওয়েব সিরিজ।’ বললেন সঞ্জীব জানা, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টান্টম্যান। তাই রুজির দায়ে, পেটের টানে আজও স্টান্ট দিতে সোনারপুর-বেহালা-বর্ধমান-ক্যানিং-হাবড়া থেকে আসেন আজিজ, সুব্রত, প্রজয়, মানিক, দেবাশিসরা। আজকের ফাইটাররা।
তথ্যসূত্র: এই সময়

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Stuntmen, #Bengali film industry

আরো দেখুন